শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দেশের পুঁজিবাজারে পতনের ঝড় থামেনি। চরম স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের পুঁজিবাজার। ধারাবাহিক পতনে দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি। ফলে টানা দরপতনে চলছে বিনিয়োগকারীদের রক্তক্ষরণ। আর অস্থিও বাজারে প্রায় প্রতিদিনই মূল্যসূচক কমছে। এর চেয়েও বেশি কমছে শেয়ারের দাম। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের অনেকেই যে কোনো মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যেতে মরিয়া হয়ে উঠছেন। তাতে বাজারে বিক্রির চাপ বেড়ে গেছে।

ফলে দেখে মনে হচ্ছে পুঁজিবাজার যেন এক আতঙ্কের নাম। তাছাড়া গত ১৪ মাস ধরে এক দিন সূচক বাড়ে তো তিন দিনই পতন। বলতে গেলে বাজারটি একেবারেই সরকারের মনোযোগের বাইরে। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল সরিয়ে একটি স্থিতিশীল ও আস্থার বাজারে পরিণত করার আন্তরিক প্রচেষ্টা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দেখা যায়নি।

বিনিয়োগকারীদের মতে, সংকটের মূল কারণ হলো দুর্বল ও তারল্য সংকটে ভোগা পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত এবং ৯টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধের প্রক্রিয়া। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় শ্রেণির বিনিয়োগকারীরা তাঁদের পুঁজির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন, যার ফলে বাজারে বিক্রয় চাপ বেড়েছে এবং মূলধন আশঙ্কাজনক হারে কমছে।

এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি আস্থার সংকটে রয়েছে ব্যাংক খাত। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ১৮টি ব্যাংকের শেয়ার ফেস ভ্যালু বা ১০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে ৫টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৫ টাকারও নিচে। অথচ এখন বাজার থেকে সাধারণ মানের একটি চকলেট কিনতে গেলেও ৫ টাকা গুনতে হয়। এমনকি এক কাপ চা কিনতেও লাগে ৫ থেকে ১০ টাকা। অর্থাৎ এক পিস চকলেট আর এক কাপ চায়ের দামে এখন একাধিক ব্যাংকের শেয়ার কেনা যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতে নানামুখী অনিয়ম ও মালিকানাধীন স্বার্থের জোটবদ্ধ দখলের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে। ফলে অনেক ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এক সময় দেশের পুঁজিবাজারের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হতো ব্যাংক খাত।

ভালো লভ্যাংশের আশায় বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করতেন। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই এই খাতে সক্রিয় থাকতেন। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংকের শেয়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো পুঁজিবাজারে।

বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩৬টি। এর মধ্যে ফেস ভ্যালু বা ১০ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে ১৮ ব্যাংকের শেয়ার। যার মধ্যে ৭টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৫ টাকার নিচে। এ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ২ টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ১ টাকা ৭০ পয়সা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ২ টাকা ৬০ পয়সা, ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার ২ টাকা ৯০ পয়সা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ার ১ টাকা ৬০ পয়সা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ৩ টাকা ১০ পয়সা এবং এক্সিম ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৩ টাকা ১০ পয়সা অবস্থান করছে।

ফেস ভ্যালুর নিচে থাকা বাকি ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের শেয়ার ৫ টাকা ১০ পয়সা, সাউথইস্ট ব্যাংকের শেয়ার ৮ টাকা ৯০ পয়সা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ৩ টাকা ১০ পয়সা, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংকের শেয়ার ৬ টাকা ৪০ পয়সা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের শেয়ার ৫ টাকা, ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার ৬ টাকা ৯০ পয়সা, এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার ৫ টাকা ৫০ পয়সা, এনআরবি ব্যাংকের শেয়ার ৬ টাকা ৪০ পয়সা, এনসিসি ব্যাংকের শেয়ার ১০ টাকা ৯০ পয়সা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শেয়ার ৭ টাকা ৮০ পয়সা, আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার ৫ টাকা, এক্সিম ব্যাংকের শেয়ার ৩ টাকা ১০ পয়সা এবং এবি ব্যাংকের শেয়ার ৫ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।

অপরদিকে, ফেস ভ্যালুর ওপরে থাকলেও ১০টি ব্যাংকের শেয়ার দাম ২০ টাকার নিচে অবস্থান করছে। এর মধ্যে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ১৪ টাকা ৬০ পয়সা, ব্যাংক এশিয়া ১৭ টাকা ৭০ পয়সা, সিটি ব্যাংক ২৪ টাকা, ঢাকা ব্যাংক ১০ টাকা ৯০ পয়সা, যমুনা ব্যাংক ২০ টাকা ৯০ পয়সা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১২ টাকা ২০ পয়সা, রূপালী ব্যাংক ১৭ টাকা ২০ পয়সা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ১৬ টাকা ৬০ পয়সা, ট্রাস্ট ব্যাংক ১৭ টাকা ১০ পয়সা এবং ইউসিবি ব্যাংক ১০ টাকায় ১০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে।

এছাড়া উত্তরা ব্যাংক ২১ টাকা ৩০ পয়সা, প্রাইম ব্যাংক ২৬ টাকা ৭০ পয়সা, ইস্টার্ন ব্যাংক ২৩ টাকা ১০ পয়সা, মিডল্যান্ড ব্যাংক ২০ টাকা ৮০ পয়সা, পূবালী ব্যাংক ২৮ টাকা ৫০ পয়সা, ইসলামী ব্যাংক ৩৭ টাকা ২০ পয়সা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৩৯ টাকা ৭০ পয়সা ও ব্র্যাক ব্যাংক ৬৮ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসই এক পরিচালক বলেন, ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যানরা যোগসাজশ করে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে লোন দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত এগুলো খেলাপি লোনে পরিণত হয়েছে। এতদিন ট্যাম্পারিং করে পার পেলেও এখন বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থানে। তাই প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে।

তালিকাভুক্ত অর্ধেক ব্যাংকের শেয়ার দাম ফেস ভ্যালুর নিচে। এটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। যার ফলে ব্যাংক খাতের দুর্দশা শুধুমাত্র এই খাতের জন্য নয়, বরং পুরো পুঁজিবাজারের জন্যই অশনিসংকেত। এই খাত পুনর্গঠন না হলে বাজারের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয়।