edtorial lago share barta    ১১টি পদক্ষেপ গ্রহন করলে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার হবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী পুজিবাজারে পরিনত হয়ে উঠবে।

১) ব্যাংক গুলোর বিনিয়োগ সীমা বৃদ্ধি করতে হবে। কারন পুজিবাজারে ব্যাংক গুলো হচ্ছে অন্যতম বড় ক্রেতা। ২০১০ সালে আগে ব্যাংক গুলো আমানতের ১০% বিনিয়োগ করতে পারতো কিন্তু ২০১৩ সালে এই নীতিমালা পরিবর্তন করে মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ সঞ্চিতি ও রিটেইন্ড আর্নিংস এর মোট ২৫% করা হয়। আপনারা সবাই জানেন একটি ব্যাংকের আমানত তার মূলধনের থেকে অনেক গুন বেশি থাকে।

তাই আগের নিয়ম অনুযায়ী আমানতের ১০% বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে।২০১০ সালে বাজার ধ্বসের জন্য কিন্তু আগের নিয়ম কে কোন ভাবেই দায়ী করা যাবেনা। ব্যাংক গুলো সেই সময় যেটি করেছিল তারা আমানতের ১০% থেকেও বেশি বিনিয়োগ করেছিল। যদি আগের নিয়মে ফিরে না যাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে মূলধনের ২৫% পরিবর্তন করে মূলধনের ৭৫% পুজিবাজারে বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
২) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাইভেট কোম্পানির (পুজিবাজারে তালিকা ভুক্ত নয়) শেয়ার গুলোও এক্সপোজার লিমিটের মধ্যে গননা করে। ধরেন NCC ব্যাংক ইগলু আইসক্রিম কোম্পানির কিছু শেয়ার ধারন করছে। সেই ক্ষেত্রে এই ইগলু আইসক্রিম কোম্পানির শেয়ারও এক্সপোজার লিমিটের মধ্যে গননা করা হয়।এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেনঅযোগ্য সিকিউরিটিজকে (প্রেফারেন্স শেয়ার, বন্ড) এক্সপোজার আওতায় গননা করে। পুজিবাজারের স্বার্থেই শুধু মাত্র পুজিবাজারে তালিকা ভুক্ত শেয়ার গুলো নিয়েই ব্যাংক এক্সপোজারে বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা উচিত। প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার এবং লেনদেনঅযোগ্য সিকিউরিটিজকে (প্রেফারেন্স শেয়ার, বন্ড) এক্সপোজার গননার আওতা থেকে বাদ দিতে হবে।
৩) বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংক গুলোর বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা হয় শেয়ারের বাজার মূল্য অনুযায়ী। এটি বাজারের জন্য অন্যতম একটি বড় বাধা।এটি অদ্ভুত একটি নিয়ম। অর্থাৎ বাজারের কোন নুতন বিনিয়োগ না করেই ক্রয় কৃত শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি পেলে ব্যাংক গুলোর বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করতে পারে। এই নিয়মটি পুরোপুরি স্তিতিশীল বাজারের পরিপন্থী। তাই শেয়াররের বাজার মূল্য নয় শেয়ারের ক্রয় মূল্য দিয়ে বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করতে হবে।
৪) পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ঋণের সীমা বৃদ্ধি করে ১:১ করা যেতে পারে। সেই সাথে ক্ষতি গ্রস্থ বিনিয়োগকারীদের আগামী ২ বছরের জন্য সকল ঋণের সুদ বন্ধ রাখা যেতে পারে।
৫) পুজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ঋণের সুদ অনুপাতিক হারে অনেক বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই হার ১৮% পর্যন্ত।পুজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের ঋণের সুদ ১০% এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রকারেজ হাউজ গুলো ৩ মাস পর পর তাদের ঋণের সুদ গুলো মূল ঋণের সাথে যোগ করে, এতে ঋণের পরিমান রাতারাতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই ঋণের সুদ গুলো বছর শেষে মূল ঋণের সাথে যোগ করতে হবে। মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রকারেজ হাউজ গুলো যখন তাদের বাৎসরিক হিসাব সমাপ্ত করবে তখন সে ঋণের সুদ গুলো মূল ঋণের সাথে যোগ করতে হবে। হতে পারে এটি জুন closing অথবা ডিসেম্বর closing.
৬) ব্যাংক গুলোর বিনিয়োগের সীমা থেকে তার সাবসিডিয়ারি কোম্পানির (মার্চেন্ট ব্যাংক এবং কিছু ব্রকারেজ হাউজ) বিনিয়োগ সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। যদিও এই বিষয়ে একটি নির্দেশনা কিছু দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় ব্যাংক গুলোর এই সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গুলো মূলধন বৃদ্ধি করতে হবে। কোন ধরনের কাল বিলম্ব করার সুযোগ এখানে নেই।
৭) নুতন যে ব্যাংক গুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে সে গুলোকে বিনিয়োগ সীমার মধ্যে থেকে পুজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে। এছাড়া নন বাঙ্কিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, লাইফ ইনস্যুরেন্স, মিউচুয়াল ফান্ড গুলোকে বাজার মুখি করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠান গুলো যদি সত্যিকার অর্থেই বাজারে সক্রিয় থাকতো তাহলে বাজারের তারল্য সংকট অনেক খানি কমে যেতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই প্রতিষ্ঠান গুলোও ভালো বাজারের অপেক্ষায় থাকে। খারাপ বাজারের এই প্রতিষ্ঠান গুলো পুজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। তাই বিভিন্ন দিক নির্দেশনার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান গুলোর পুজিবাজারে সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

ICB (Investment Corporation of Bangladesh) কর্ম কাণ্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। পতন শীল বাজারে ICB আসলে কি ভুমিকা পালন করেন তা নিয়ে জনমতে সন্দেহের দানা বেড়েই চলেছে। ICB এর সকল কর্মকাণ্ডে নজরদারি বাড়াতে হবে। তাদের কাজ কর্মে আরও স্বচ্ছতা আনতে হবে। একটি শক্তিশালী বাজার দার করানোর জন্য ICB এর ভুমিকা অপরিসীম। তাই বাজারের গতি ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকে অবশ্যই ICB কে অর্থের যোগান দিতে হবে। শুধু অর্থের যোগান দিলেই হবে না । সেই অর্থ তারা কি ভাবে বিনিয়োগ করছে তার উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

৯) বর্তমানে পুজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট খুব বেশি। ২০১০ সালে বাজার ধ্বসের পর কোন ভাবেই এই সংস্থা বাজারের গতি ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বাজারে যেখানে তারল্য সংকট সেখানে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্দোগ না নিয়ে তার উল্টা কাজটি করলো। বাজারে নুতন নুতন শেয়ার তালিকাভুক্ত করে বাজারে শেয়ারের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়া হল। যদিও নুতন নুতন কোম্পানি গুলো কতটা মান সম্পূর্ণ তা নিয়ে বাজারে অনেক কানা গোসা রয়েছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় এমন লোক নিয়োগ দেয়া উচিত যিনি দীর্ঘ দিন থেকে পুজিবাজারের সাথে সম্পৃক্ত। যিনি পুঁজিবাজারের সমস্যা গুলো বুজতে পারবেন এবং তার সমাধান করতে সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবেন। ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশের পুজিবাজারের স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। যার কথার সাথে কাজের মিল থাকবে।

সময়ের সাথে সাথে বিনিয়োগকারীগণ তাকে পুঁজিবাজারের অভিভাবক হিসেবে দেখতে পাবে। তিনি যে পুজিবাজারের জন্য কাজ করছেন এটি সরকার নয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিশ্বাসের সৃষ্টি করাতে হবে। শুধু BSEC নয়, পুজিবাজার সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানে পুজিবাজার সম্পর্কে ধারনা রাখেন এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে একজন হলেও পুজিবাজার বিশ্লেষক নিয়োগ দিতে হবে যিনি ব্যাংক গুলোর পাশাপাশি পুঁজিবাজারের স্বার্থেও কথা বলতে পারবেন।

১০) মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রকারেজ হাউজ গুলোর উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। বিশেষ করে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রকারেজ হাউজ গুলোর প্রধান কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ডের উপর বিশেষ নজরদারি করতে হবে। এই জন্য একটি শক্তিশালী কমেটি গঠন করা যেতে পারে যা কিনা সরাসরি অর্থ মন্ত্রালয়ের অধিনে থাকবে। এই কমিটি DSE এবং BSEC থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করবে। শুধু তাই নয় DSE,BSEC এবং ICB কর্মকাণ্ডের উপরও এই কমেটি সজাগ দৃষ্টি রাখবে। তবে সেই কমিটির সদস্যদের অবশ্যই পুজিবাজার সম্পর্কে ধারনা থাকতে হবে।

১১) পুঁজিবাজারের তারল্য সংকট দূর করতে সরকারকে সরাসরি এই বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থ মন্ত্রালয়ের মাধ্যমে এই বিনিয়োগ আসতে পারে। এই বিনিয়োগের পরিমান ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা হতে হবে। তবে একটি কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, সেটি হল এই ধরনের ফান্ড কিন্তু আবার বাজারের জন্য ক্ষতির কারনও হয়ে দাড়াতে পারে। যদি না সেই টাকার সৎ ভাবে ব্যবহার করা না হয়। অনেক সময় এমন হয় এই ধরনের আপদ কালীন সরকারী বিনিয়োগ জুয়ারিদের পক্ষে কাজ করে।

তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই ধরনের অর্থ পুজিবাজারে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে বাজারের যখন বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব পরিলক্ষিত হবে তখন এই অর্থের ব্যবহার সু নিশ্চিত করতে হবে এবং সেই সাথে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। অতিতে “বাংলাদেশ ফান্ড” নামে একটি ফান্ড গঠন করা হয়েছিল। যা বাজারের গতি ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

অনেকেই বলেন বাজারে একটি জিনিসের খুব অভাব তা হল বিনিয়োগকারীদের আস্থার খুব অভাব। যদি ধরে নেই তাদের কথা সত্য তাহলে আমার প্রশ্ন হল বিনিয়োগকারীদের এই আস্থা কে ফিরিয়ে আনবে? এই আস্থার সংকট দূর করতে কিন্তু সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আপনি ৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছেন, মাস না পেরোতেই সেই টাকা যদি ৪ লক্ষ হয়ে যায় সেই বাজারে আর যাই হোক ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ নিয়ে আশা কঠিন।

বাজারের গতি যখন ফিরে আসবে তখন ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ এমনেতেই চলে আসবে। পুজিবাজারের এই দুরবস্থায় শুধু বিনিয়োগকারী নয় আনেক ভালো ভালো কোম্পানিও পুজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাচ্ছেনা। আমার ধারনা বাজার যদি আবার তার গতি ফিরে পায় তাহলে ভালো ভালো কোম্পানি গুলোও পুজিবাজারে তালিকা ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে। আমাদের দেশের প্রবাসী ভাইয়েরা কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়।

আর সেই অর্থ বিনিয়োগ করে জমিতে। গত ১ দশকে জমির দাম প্রায় ক্ষেত্র বিশেষে ৫০ গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। জমির এই দাম বৃদ্ধির পেছনে প্রবাসী ভাইদের বিনিয়োগে অন্যতম বড় ভুমিকা রেখেছে। অথচ তাদের এই বিনিয়োগ কিন্তু তারা পুজিবাজারেও করতে পারে। কিন্তু করে না। কারন কিন্তু একটিই পুজি হারানোর ভয়। অথচ তাদের এই বিনিয়োগ যদি পুজিবাজারের আনা সম্ভব হতো তাহলে দেশের শিল্প খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হতো।
.
পুঁজিবাজারের এই গতি ফিরিরে আনতে পারে এই মুহূর্তে একমাত্র দেশের সরকার। উপরের যে পদক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে সেই পদক্ষেপ গুলো যদি সরকার বাস্তবায়ন করে তাহলে আমি বিশ্বাস করি পুঁজিবাজারের গতি ফিরে আসবে।

পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনীতির দর্পণ (আয়না)। কথায় আছে, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দিবো। এই বাক্যটির সুরে শুর মিলিয়ে বলতে চাই, আমাকে একটি গতিশীল পুঁজিবাজার দাও আমি তোমাদের একটি গতিশীল অর্থনীতি দেব।

তানভীর আহম্মেদ, বিনিয়োগকারী