ibrahim khladশেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সাথে বর্তমান পুঁজিবাজার বিষয় একান্ত আলোচনায় ………

শেয়ারবার্তা: ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর পাঁচ বছরেরও বেশি সময় চলে গেছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না কেন?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: বর্তমানে আস্থাহীনতাই শেয়ারবাজারের মূল সংকট। আস্থাহীনতার কারণেই বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আগ্রহ পাচ্ছেন না। আস্থার সংকট প্রকট। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে দুই দফায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এ কারণে যাঁরা সেখানে ব্যবসা করতেন, তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

শেয়ারবার্তা: ২০১০ সালের পর তো অনেক ধরনের সংস্কার ও পরিবর্তন আনা হয়েছে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ধসের পর বাজার সংস্কারে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, সেটি বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, গ্রহণ করা ব্যবস্থাগুলো বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর জন্য যথেষ্ট কি না। পুঁজিবাজারের আচরণটাই একটু ভিন্ন রকমের। এটা সম্পূর্ণই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে চলে। যাঁদের জন্য বিনিয়োগকারীর বিশ্বাস বা আস্থা নষ্ট হয়, তাঁরা যখন বাজারে দৃশ্যমান থাকেন তখন বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস ফেরানো মুশকিল। ২০১০ সালে যাঁদের কারণে বাজারে ধস নেমেছিল, তাঁরা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বলতে গেলে তাঁরাই বাজার পরিচালনা করছেন। আস্থাহীনতার পেছনে এটি একটি বড় কারণ।

শেয়ারবার্তা: কিন্তু ধসের পর স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করার (ডিমিউচুয়ালাইজেশন) মাধ্যমে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর কোনো সুফল মিলছে না কেন?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ডিমিউচুয়ালাইজেশনের কারণে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রশাসন ও মালিকানা আলাদা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত ডিমিউচুয়ালাইজেশন বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি বাংলাদেশে। সরকার নিয়োজিত নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের পাশাপাশি স্টক এক্সচেঞ্জের মালিক যাঁরা, তাঁরা একসঙ্গে মিলেমিশে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করছেন। সাধারণ মানুষ বা বিনিয়োগকারী যখন দেখেন যে একসঙ্গে বসেই স্বাধীন পরিচালক ও স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকেরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন সন্দেহ থেকেই যায়। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা ও অবস্থানটি বড় বিষয়।

শেয়ারবার্তা: ধসের পর তো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও পুনর্গঠন করা হয়েছে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ধসের আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজনই সরাসরি বাজারের প্লেয়ারদের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। আমাদের তদন্ত প্রতিবেদনে তার কিছু তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছিল। বর্তমান কমিশন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত হয়তো সেই ধরনের তথ্য-প্রমাণ নেই। কিন্তু বাজারে আস্থা ফেরানোর জন্য পুনর্গঠিত কমিশনের যে ধরনের শক্তিশালী ও সৎ অবস্থান তৈরি করা দরকার ছিল, সেটি তাঁরা করতে পারেননি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) যে ভাবমূর্তি তৈরি করা দরকার ছিল, সেটি হয়নি। বিএসইসি যে সত্যিকারের একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সেই প্রমাণ এখনো কমিশন দিতে পারেনি। বর্তমান কমিশন অত্যন্ত দুর্বল কমিশন। তাই এ কমিশনের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা।

শেয়ারবার্তা: তাহলে করণীয় কী?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: এক কথায় বলতে পারি, বর্তমান কমিশনের ওপরও বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। এমনকি কমিশনের কারও কারও সততা নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মনে সন্দেহ আছে। যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হয়, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব বিএসইসির প্রধান বা চেয়ারম্যানের পদটিতে পরিবর্তন আনা দরকার। এমন একজনকে চেয়ারম্যান করা দরকার, যার অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের আস্থা রয়েছে। এমন একজন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা দরকার যিনি সৎ, দক্ষ এবং অতীতে বিভিন্ন শক্তিশালী ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেটি করা গেলে বাজারে একটি ভালো বার্তা পৌঁছাবে। যাঁরা বাজারের প্লেয়ার, তাঁরাও সাবধান হয়ে যাবেন।

শেয়ারবার্তা: বিএসইসির চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন হলেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: যদি সৎ, দক্ষ ও কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ করা যায়, তাহলে অবশ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থা সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ধারণা পাল্টাবে। এ ধরনের সংস্থায় প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি চান, তাহলে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিই পাল্টে দিতে পারেন। বর্তমান চেয়ারম্যানের সেই দক্ষতা আছে বলে আমি মনে করি না। এখন পর্যন্ত তাঁর যেসব কর্মকাণ্ড আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি, তাতে যে কারও মনে হতেই পারে যে রাজনৈতিক বিবেচনাতেই তাঁকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

শেয়ারবার্তা: আপনাদের তদন্ত প্রতিবেদনে কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন। কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে এ বিষয়ে?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ডিমিউচুয়ালাইজেশনসহ কিছু কিছু সুপারিশের ক্ষেত্রে কিছুটা কাজ হয়েছে। কিন্তু অপরাধীদের শাস্তির বিষয়ে বিএসইসি অত্যন্ত দুর্বল ছিল। কাউকেই তারা শাস্তি দিতে পারেনি। আমরা দেখলাম বিএনপি-দলীয় নেতা মোসাদ্দেক আলীকে বিএসইসি এক কোটি টাকা জরিমানা করেছে। লোকে বলছে, উনি বিরোধী দলের লোক বলেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রতিবেদনে আমরা সরকারদলীয় লোকেরও অপরাধ তুলে ধরেছিলাম। তাঁদের অপরাধ মোসাদ্দেক আলীর চেয়েও বেশি ছিল। বিশেষ করে আমরা জিএমজি এয়ারলাইনস সম্পর্কে কেস স্টাডি তুলে ধরেছিলাম। সেটি খুবই তথ্যনির্ভর ছিল। কিন্তু জিএমজির ঘটনাটি তো বিএসইসি তদন্তও করল না। শুধু বিরোধী দলের লোক বলে কাউকে শাস্তি দেওয়া হবে আর সরকারি দলের লোকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না—এটি হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারও আস্থা অর্জন করতে পারবে না।

শেয়ারবার্তা: কিন্তু বর্তমান কমিশন তো শেয়ারবাজারের মামলা নিষ্পত্তির জন্য আলাদা একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ আমাদের প্রতিবেদনেও ছিল। আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, এটা ভালো দিক। কিন্তু এখন আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, কিছুদিন না যেতেই ট্রাইব্যুনালে মামলার সংকট। আবার শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত অনেক মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়ে আছে। সেসব মামলার ওপর থেকে স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বিএসইসির তেমন কোনো সক্রিয় উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না।

শেয়ারবার্তা: শেয়ারবাজারকে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে শেয়ারবাজারে প্রাণ ফিরবে?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা শেয়ারবাজারের উন্নয়নে কোনো অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি না। যেসব ব্যাংক আইন লঙ্ঘন করে বাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেছিল, সেসব ব্যাংককে হয়তো দম ফেলার কিছুটা সময় দেবে। কারণ আইনের প্রয়োগকে নমনীয় করতেই বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইন প্রয়োগে নমনীয়তার পরিবর্তে কঠোরতায় মানুষের আস্থা ফেরাতে সহায়তা করে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি চাপে পড়ে নিয়েছে।

শেয়ারবার্তা: শেয়ারবাজার কারসাজিমুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: আমি সেটা মনে করি না। শেয়ারবাজার এখনো ত্রুটিমুক্ত হয়নি। এখনো বাজার একটি সুনীতি কাঠামোর মধ্যে আসেনি। এ কারণে ভালো কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে না। কারণ যেসব কোম্পানি ভালো সুনাম করেছে, তারা কখনো একটি মন্দ আবহাওয়ায় অবগাহন করতে চায় না।

কেউ তার অর্জিত সুনাম নষ্ট করতে চায় না। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত বাজার স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো ভালো কোম্পানি বাজারে আসবে না। এর ফলে বাজারে একটি দুষ্টচক্র তৈরি হচ্ছে। ভালো কোম্পানি আইপিওতে না আসার কারণে বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে না। ফলে একই দুষ্টচক্রে বাজার ঘুরপাক খাচ্ছে।