পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিবিধ খাতের কোম্পানি আরামিট লিমিটেডের শেয়ারদর অস্বাভাবিক পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে। গত কয়েক মাস ধরে বাজার মন্দার কারণে মৌলভিত্তিসম্পন্ন অনেক কোম্পানির শেয়ারের দর কমলেও আরামিট লিমিটেডের শেয়ারের দর লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এছাড়া আরামিট লিমিটেডের শেয়ারের দর গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরে অবস্থান করছে।

ফলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে এ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মন্দার বাজারে কি করে আরামিটের শেয়ারের দর ধারাবাহিক ভাবে বাড়ছে এ বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।

মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারের দর বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। চলতি বছরের আগষ্ঠ থেকে শেয়ারটির দর বাড়ছে। মাসের ১লা সপ্তাহে শেয়ারটির দর ছিল ২৫০। চলতি মাসে তা ৪৭১ টাকায় অবস্থান করছে। অর্থাৎ ৪ মাসে শেয়ারদর বেড়েছে ২২১ টাকা।

এদিকে অস্বাভাবিক দর বাড়ায় কারণ জানতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নোটিশ দেয়। জবাবে দর বাড়ার অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে গতানুগতিক উত্তর জানিয়েছে কোম্পানিটি। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সপ্তাহজুড়ে টপটেন গেইনারে রয়েছে ছিল আরামিট লিমিটেড।

এদিকে সপ্তাহ জুড়ে কোম্পানির শেয়ার দর ১৬ দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহে প্রতিদিন কোম্পানিটি লেনদেন করেছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৮৭ হাজার ৮০০ টাকার শেয়ার। আর পুরো সপ্তাহজুড়ে লেনদেন হয়েছে ৭ কোটি ৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকার শেয়ার।

এদিকে আরামিটের শেয়ারপ্রতি তৃতীয় প্রান্তিকে আয় (ইপিএস) কমেছে ২৫.১৫। আগের হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের তুলনায় চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির এ আয় কমেছে।  চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই ’১৫ থেকে সেপ্টেম্বর ’১৫) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী আরামিটের শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ২.৫৩ টাকা। আগের বছর একই এ আয়ের পরিমাণ ছিল ৩.৩৮ টাকা। এ হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিটির ইপিএস কমেছে ২৫.১৫ শতাংশ।

অপরদিকে চলতি হিসাব বছরের প্রথম ৯ মাসের (জানুয়ারি ’১৫ থেকে সেপ্টেম্বর ’১৫) অনিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৯.৯৬ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এ আয়ের পরিমাণ ছিল ১০.৫৯ টাকা। এ হিসাবে আগের হিসাব বছরের তুলনায় চলতি হিসাব বছরের প্রথম ৯ মাসে কোম্পানিটির ইপিএস কমেছে ৫.৯৫ শতাংশ। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৫০.৭৫ টাকা। ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৪০.৩২ টাকা।

একাধিক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করে বলেন, আরামিটের শেয়ার ধারাবাহিক ভাবে বাড়ার কারন কি? যেখানে গত বছরের তুলনায় শেয়ার প্রতি আয় কমছে, সেখানে টানা দর বৃদ্ধির কারন কি। এ দরবৃদ্ধির পেছনে কারসাজির অভিযোগ তোলেন বিনিয়োগকারীরা। এ বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।

এদিকে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে আরামিট কোম্পানির মৌলভিত্তির সঙ্গে কোনো ধরনের সামঞ্জস্যতা নেই বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এর পেছনে কারসাজি থাকতে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করছেন তারা।

দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, আরামিট লিমিটেড গত ছয় বছরে মুনাফা করে প্রায় ৫৩ কোটি ৬০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০১৩ এবং ১৪ সালে মুনাফা কোম্পানির মুনাফার পরিমান কিছুটা কমছে। কোম্পানির সম্পদের পরিমান ব্ড়ালে ও রহস্যজনকভাবে কোম্পানিটি ডিভিডেন্ডের পরিমান বাড়ছে না । ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

বর্তমানে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় ১২.৭ টাকা। এছাড়াও বর্তমানে কাম্পানির সম্পদমূল্য দেখানো রয়েছে ১৪০ টাকা ৩২ টাকা। তবে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সম্পদ মূল্য বাড়ছে। এমতাবস্তায় কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভাল বলে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন। এছাড়া কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৪ সালে ৫০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। কোম্পানিটি মাত্র ১ বার ২০০৯ ৫০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষনা করে। এছাড়া ধারাবাহিক ভাবে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিচ্ছে। কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা ৬০ লাখ।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে আরামিট লিমিটেডের মুনাফা হয়েছে ৭ কোটি ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২০০৯ সালে মুনাফা হয়েছে ৮ কোটি ২৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ২০১০ সালে হঠাৎ কোম্পানির মুনাফা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৮০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ২০১১ সালে কোম্পানিটির মুনাফা করে ৮ কোটি ৫৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে মুনাফা ৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে আবার মুনাফা কিছুটা কমে এর পরিমাণ দাড়ায় ৭ কোটি ৫০ হাজার টাকা। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি মুনাফা করে ৭ কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। কোম্পানিটি এ যাবৎ কালে কোন রাইট শেয়ার ঘোষনা করেনি। রিজার্ভের পরিমান ৭৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

ডিএসইর ওয়েবসাইটে ৮ই নভেম্বর দর বাড়ার প্রসঙ্গে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত নোটিশ- আরামিট নোটিশের প্রতি যেন ডোন্ট কেয়ার। যে কারণে শেয়ারটির অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। শেয়ারটির দর গত ৮ নভেম্বর দিনশেষে ৩৭ টাকা ৭০ পয়সা বেড়ে যায়। এদিন শেয়ারটির লেনদেন ৪০৫ টাকায় শুরু হয়ে সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৪৩৪ টাকায়। আগেরদিনের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৪০৩ টাকা ৩০ পয়সা। শেয়ারদর বাড়ার কারণে পরিবর্তন হয়েছে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।

এর আগে শেয়ারটির অস্বাভাবিক দর বাড়ার পেছনে কারণ জানতে ডিএসই চলতি বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর নোটিশ পাঠায়। ডিএসইর ওয়েবসাইটে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সেই নোটিশ-
কোম্পানির গত ১ মাসের বাজারদর-ARAMIT- 1 month

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, যদিও চলতি মাসের ২ তারিখ থেকে শেয়ারটির দর বাড়ছে, ৪ তারিখ থেকে খাড়াভাবে অর্থাৎ, সূচক প্রায় রকেটের উড্ডয়ন পথ অনুসরণ করেছে। ২ থেকে ৮ই নভেম্বর পর্যন্ত শেয়ারদর ৮১ টাকা ৭০ পয়সা বেড়ে ৩৪৬ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৪২৮ টাকা ৬০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।

গত ৬ মাসের বাজারদর-ARAMIT 6 month

চিত্রে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন মাস থেকে শেয়ারটির দর বাড়ছে। মাসের ১লা সপ্তাহে শেয়ারটির সর্বনিম্ন দর ছিল ২১৮ টাকা ৪০ পয়সা। চলতি মাসে তা ৪২৮ টাকা ৬০ পয়সায় অবস্থান করছে। অর্থাৎ, ৬ মাসে শেয়ারদর বেড়েছে ২১০ টাকা ২০ পয়সা।

আরামিট লিমিটেড ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ মাত্র ১০ কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৬ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধনের ৩৪.৯৪ শতাংশ শেয়ারই কোম্পানির পরিচালকদের হাতে রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৪.৯১ শতাংশ এছাড়া বাকি ৩০.১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাছে।

এ ব্যাপারে কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক ও সচিব মি. বি গুপ্ত বলেন, শেয়ারের দর ধারাবাহিক বাড়ার কারন কি তা আমরাও বলতে পারছি না। আমরা কোন কারসাজি সাথে জড়িত ছিলাম না এখনো নেই। কেউ যদি বলে কারসাজি আছে তা বের করতে বলেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘যে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়ার বিষয়টি ডিএসইর নজরে আসলে তা যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়। অনেক সময় বিএসইসি তাদের মনিটরিংয়ের ওপর ভিত্তি করে ডিএসইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে থাকে। নিজ উদ্যোগে বা বিএসইসির নির্দেশে যে তদন্তই হোক না কেন তা বিএসইসিতে দাখিল বা অবহিত করা হয়। এক্ষেত্রে কারসাজির সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বিএসইসি।’

এ বিষয়ে বিএসইসি’র এক উর্ধ্বত কর্মকর্তা দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলেই যে কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বিএসইসি যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

আমিনুল ইসলাম