শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ধুঁকে ধুঁকে মরছে। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীদের অর্থের যোগানদাতা দেশের পুঁজিবাজার নিজস্ব শক্তিমত্তা নিয়ে আজো গড়ে উঠতে পারেনি।তবে স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে না উঠার নেপথ্যে কারসাজি চক্র। কারন এদের ইশরায় বাজার বাড়ে, এদের ইশরায় বাজার কমে। ফলে পুঁজিবাজারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কারসাজি চক্র।

এই চক্র একের পর এক কোম্পানির শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। তবে এই চক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে কারসাজির মাধ্যমে এই দাম বাড়ানো হয়েছে। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তথ্য প্রচার করে শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই কারসাজি বন্ধ করতে পারছে না। কারসাজি বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিএসইসি কারসাজি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়নি।

এছাড়া দীর্ঘ এক বছর মন্দা পুঁজিবাজার গেলেও সরকার সহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোন উদ্যোগই সফল হচ্ছে না। ফলে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি দিন দিন আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। যার ফলে উভয় পুঁজিবাজারের সূচক পতনের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

তবে টানা দরপতন হলেও কারসাজি থামছে না। পুঁজিবাজারে একের পর এক কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। যেসব কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য হচ্ছে, শেয়ারের দাম বাড়ার তো কোনো কারণ নেই, নেই কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্যও। তারপরও বাড়ছে শেয়ারের দাম।

পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্রেফ কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হচ্ছে।ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারের দাম ন বাড়লেও দুর্বল মৌল ভিত্তি শেয়ারের দাম বাড়ছে হু হু করে। তারা বলছেন, সবপক্ষই মিলেমিশে টাকা লুটপাটের মহোৎসবে মেতেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আইনজীবী, অডিটর, প্রশাসন ক্যাডার কেউ যেন বাদ যাচ্ছেন না। বিষয়টি দেখভালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থাকলেও তারাও দায় নিচ্ছেন না!

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন পুঁজিবাজার ইস্যুতে নানা ভাল খবর থাকলেও বাজার প্রতিনিয়ত দরপতন হচ্ছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বরং অদৃশ্য শক্তিতে ঘুরপাত খাচ্ছে পুঁজিবাজার। এ পরিস্থিতিতে লেনদেন ক্রমাগত কমে যাওয়া পুঁজিবাজারের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

দীর্ঘ প্রায় এক বছরের মত টানা দরপতন চলছে পুঁজিবাজারে। মাঝে মধ্যে দুই চার বাজার বাড়লেও অধিকাংশ কার্যদিবসে সূচকের দরপতন চলছে। আর লম্বা সময় দরপতনে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হারিয়ে। আর যারা মার্জিন লোনে ব্যবসা করছে তাদের অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের পুঁজি নেগেটিভ।

ফলে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং দুঃশাসন দমন করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নিয়ে গড়েই উঠতে পারেনি দেশের পুঁজিবাজার। উন্নত থেকে শুরু করে উদীয়মান সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতন হয়। এক বছর উত্থান হয় তো পরের বছরই পতন। এক শেয়ারের দাম বাড়ে তো আরেক শেয়ারের দাম কমে। আসলে এটি নির্ভর করে কোম্পানির পরিচালন দক্ষতা ও মুনাফার ওপর।

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি কেতাবি নিয়ম। কারসাজিই এই বাজারের শেয়ারের দাম উত্থান-পতনের মূল কারণ। কারসাজির কারণে ভালো মৌল ভিত্তি কোম্পানির শেয়ারের দাম তলানিতে থাকে আর মন্দ কোম্পানির শেয়ার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, পুঁজিবাজারকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। আর বিভিন্ন সময়ে যারা কারসাজিতে যুক্ত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারসাজি চক্রের শাস্তি নিশ্চিত না করলে পারলে পুঁজিবাজার কখনো স্থিতিশীল হবে না।

সূত্র জানায়, কারসাজি চক্রের ফাঁদে পড়ে মুনাফার আশায় লগ্নি করা বিনিয়োগকারীরা মূল পুঁজি হারাতে বসেছেন। গুটিকয় স্বার্থান্বেষী তাদের টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে। গত দুই বছরে হাতেগোনা কয়েকটি চক্র নিজেরা শেয়ার কেনাবেচা করে ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করতে নানা গুজব ছড়িয়ে শেয়ারের দর বাড়িয়ে ছিল।

ফলে সে সকল কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রায় ১ শত শতাংশ আবার দরপতন ঘটছে। ফলে কারসাজি চক্ররা লাভবান হলেও নি:স্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও প্রলুব্ধ হয়ে যখন শেয়ার কিনেছেন এবং দর বেড়েছে, তখন ওই চক্র তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে ক্রমাগত দর হারাচ্ছে শেয়ারগুলো।

তারা বলছেন, এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছলতা হারাচ্ছেন। পাশিপাশি ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাওয়ায় তারা বিপাকে পড়ছেন। বাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভরসাস্থল তৈরি করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া দ্রুত প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে কোনো একটি চক্রের ইশারায় চলছে পুঁজিবাজার এমনটা দাবি বিনিয়োগকারীদের। আর এসব চক্র এতই শক্তিশালী যে তাদের কাছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে দাবি করে বিনিয়োগকারীরা। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কারসাজির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আজও পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এতে আরো বেপরোয়া হয়ে পড়ছে কারসাজি চক্র।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক কাজী হোসাইন আলী বলেন, পুঁজিবাজার পুরোপুরি সিন্ডিকেট চক্রের দ্বারা জিম্মি। ২০১০ সালের পর থেকে বাজার বার বার স্থিতিশীলতার উকি মারলেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। আর স্থিতিশীল না হওয়ার মূল কারণ সিন্ডিকেট চক্র। এ চক্রটির কারণে পুঁজিবাজার এখন পুরোপুরি কৃত্রিমভাবে চলছে। এখনকার লেনদেনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে গুটিকয় ব্যক্তি ও তাদের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে।

তারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার কেনাবেচা করে লেনদেন বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো কারসাজি চক্র বেপরোয়া। তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা জড়িয়ে পড়েছেন কারসাজিতে। অনেক প্রভাবশালীও শেয়ার কেনাবেচা করছেন। এসব জেনেও কী করে তা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তা না করে উল্টো কারসাজি চক্রের হাতে একের পর এক ব্রোকারেজ লাইসেন্স তুলে দিচ্ছে বিএসইসি।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘দেশের পুঁজিবাজার অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে কারসাজি চক্র। তারা ভালো কোম্পানির চেয়ে উৎপাদন বন্ধ ও স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ করছে। সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে এসব কোম্পানির শেয়ারে দাম বাড়াচ্ছে, এরপর শেয়ার বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অতি লাভের আশায় এসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করছে।’

তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের ৭০-৮০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর মাত্র ২০-৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারী লাভবান হচ্ছেন। ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত বাজার ও বিনিয়োগকারীদের রক্ষার স্বার্থে কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’

তিনি আরো বলেন, এই চক্রটি গত এক বছর আগে বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে ৩ গুন থেকে ৫ গুন দর বাড়িয়েছিল। এর পর যখন সাধারন বিনিয়োগকারীরা বীমা খাতে শেয়ার কিনতে থাকে তখন কারসাজি চক্ররা বিক্রি করে বের হয়ে যান। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারন বিনিয়োগকারীরা। আর এ চক্রটি একটাই শক্তিশালী যে এদের ইশারায় পুঁজিবাজার বাড়ে, এদের ইশরায় পুঁজিবাজার দরপতন হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা চেষ্টা করছে। তবে একটি চক্র কারসাজি করে দুর্বল মৌল ভিত্তি শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, ‘পুঁজিবাজারে এখন কোন কোম্পানির শেয়ার, কে দাম বাড়াচ্ছে তা ওপেন সিক্রেট। ফলে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কোনো ধরনের বাছবিচার ছাড়াই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ এসব শেয়ার কিনছেন। এদের মধ্যে কেউ লাভের মুখ দেখছেন, আবার কেউ লোকসান গুনছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেভাবে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে, তা বাজারের স্বাভাবিকতা নষ্ট করছে। পুঁজিবাজার বিনিয়োগের বদলে এখন আইটেমের বাজারে পরিণত হয়েছে। আলোচিত বিনিয়োগকারীরা যে কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, তার দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাজারের ভিত দুর্বল হয়ে পড়বে।’