শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে টানা ছয় কার্যদিবস ধরে দরপতনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে। ফলে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে দোটানায় রয়েছে বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন। সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে সূচকের আতঙ্ক ধরানো পতনে ২০১০ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়।

দিনভর বিক্রির চাপে সূচকের বড় দরপতন হয়। শেয়ার বিক্রির চাপে এক পর্যায়ে বেশিরভাগ কোম্পানির ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছিল না। দিনশেষে প্রধান পুঁজিবাজারে মাত্র ৩৩টি কোম্পানির দর বেড়েছে। উল্টো কমেছে ৩২৪টি কোম্পানির দর।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত কয়েকদিনের মতো সোমবারও সূচকের ইতিবাচক প্রবণতা দিয়ে লেনদেন শুরু হয়েছিল। কিন্ত বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা সত্যি করে কিছুক্ষণ পরেই পুঁজিবাজারে ফিরে আসে সেই ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। সোমবারের পতন দেখে মনে হচ্ছিল ঠিক এক দশক আগে ২০১০ সালের পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি।

বিনিয়োগকারীদের পোর্টফলিওতে যেন হঠাৎ করেই টাকা হাওয়া হয়ে যাচ্ছিল। এই নিয়ে টানা ছয় কার্যদিবস পতন হয়েছে পুঁজিবাজারে। এই ছয় কার্যদিবসে ২৭০ পয়েন্ট সূচক কমেছে। এতে করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একপ্রকার অস্থিরতা বিরাজ করছে।

স্টক অ্যান্ড বন্ডের বিনিয়োগকারী অধ্যাপক হোসাইন আলী কাজী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি বিনিয়োগকারীদের যে আস্থা ছিল তা ধীরে ধীরে চিরকুট হতে শুরু করছে। একবার চেয়ারম্যান স্যার বলে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করুন, আবার বলে ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, আবার বলে বীমা খাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এমন নানা মন্তব্য বিনিয়োগকারীরা দিকবেদিক হয়ে পড়ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত কোন সেক্টর নিয়ে একক ভাবে মন্তব্য না করা। কারন নিয়ন্ত্রক সংস্থা রেগুলটি বোর্ড। এটা তার বুঝা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এম সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পুঁজিবাজারের গত কয়েক দিনের আচরন নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন। কারন গত ১ মান ধরে টানা দরপতনে মুল পুঁজি ৩০ শতাংশ হারিয়ে গেছে। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্রুত বাজার বান্ধব সিদ্ধান্ত না নিলে বিনিয়োগকারীরা আরো ক্ষতির শিকার হবেন।

মশিউর সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারীরা স্বপন মিয়া বলেন, পুঁজিবাজারের মেঘ যেন হঠাৎ কালো হয়ে গেল। যেখানে ২০-২৫ জাহার সূচক যাবে এরকম নানা বক্তব্যের পর বাজার যদি টানা দরপতন ঘটে তা হলে বিনিয়োগকারীরা কি ভাবে ভরসা পাবে। এতে করে আমার মতো স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগকারীদের মাঝে এখন আবার অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিভিন্ন সময় আমাদের এই বাজারে নিরাপদ বিনিয়োগের আশ্বাস দেয়া হলেও তা মূলত লোক দেখানো মনে হচ্ছে। এছাড়া নানা দেশে বিএসইসির রোড শো কোন কাজে আসছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজার এখন একটি পর্যায়ে এসেছে। বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার টানা বেড়েছে, এখন এসব কোম্পানিতে মূল্য সংশোধন হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার মত কোনো ঘটনা পুঁজিবাজারে ঘটেনি বলে মনে করেন তিনি। শিগগিরই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।

অধ্যাপক আবু আহম্মেদ বলেন, পুঁজিবাজার একটানা উর্ধ্বমুখী যেমন কাম্য নয় তেমনি বাজার একটানা পতন স্থিতিশীল বাজারের লক্ষণ নয়। আজকের বাজারের লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে দরপতন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত।

সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পুঁজিবাজারে যে পতন হয়েছে স্বল্প সময়ের জন্য এমনটি হতে পারে। তবে সূচকের পতনটি কিছুটা সময় নিয়ে হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আর সূচক শত পয়েন্টের বেশি নেমে আসলে স্বাভাবিকভাবেই সেটিকে অস্বাভাবিক মনে হবে।’ ‘বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতাটি তৈরি হওয়া উচিত। তারা যেন আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি না করে। তাহলে আল্টিমেটলি পুঁজিবাজার ভালো হওয়ার চেয়ে খারাপই হবে।’

এদিকে টানা পাঁচদিন দরপতনের পর বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপে সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে পুঁজিবাজারে ধসে নেমে এসেছে। এদিন লেনদেন হওয়া ৩৭৪ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের মধ্যে দাম কমেছে ৩২৪টির, আর বেড়েছে মাত্র ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। তাতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৮৯ পয়েন্ট। অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সূচক কমেছে ৩১৫ পয়েন্ট। সূচকের পাশাপাশি ডিএসইর লেনদেন কমে প্রায় তিন মাসের সর্বনিম্ন স্থানে নেমে চলে এসছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত সোমবার থেকে রোববার (১১ থেকে ১৭ অক্টোবর) পর্যন্ত বস্ত্র, বিমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং ওষুধ ও রসায়ন খাতের দাম কমেছিল। এই কয়েক দিন কেবল ব্যক্তিক্রম ছিল ব্যাংকের শেয়ার। তবে আজ সোমবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তগুলোর ব্যাংকের শেয়ারের দামও কমেছে।

প্রায় সব কোম্পানির দাম কমায় পুঁজিবাজার এখন ধসে রূপ নিয়েছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নতুন করে এই ধসে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় আরও ঢুকেছে, বাজারে আরও পতন হতে পারে। তাই তারা দ্রুত শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে টাকা ক্যাশ করে নিচ্ছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, আজ ডিএসইতে ৩৭৪টি কোম্পানির ৩২ কোটি ৪৯ লাখ ৩৬ হাজার ১০৬টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩টি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ৩২৪টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ১৭টির। প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম কমায় ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের চেয়ে ৮৯ পয়েন্ট কমে ৭ হাজার ৯৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

প্রধান সূচকের পাশাপাশি ডিএসইর অন্য সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ২১ দশমিক ১৪ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৫২৫ পয়েন্টে ও ডিএসই-৩০ সূচক ২৬ পয়েন্ট কমে দুই হাজার ৬৭৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আজ ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৩৯৩ কোটি ৮৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ, আগের দিনের চেয়ে লেনদেন প্রায় তিনশ কোটি টাকা কম। যা গত ২ মাস ২৩ দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন। এর আগে চলতি বছরের ২৫ জুলাই ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। এরপর দিন ২৬ জুলাই লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

এদিন ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারের। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার। তৃতীয় স্থানে ছিল লাফার্জহোলসিমের শেয়ার। এরপর যথাক্রমে ছিল, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ফরচুন সুজ, বেক্সিমকো লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, জেনেক্সইনফোসেস এবং পাওয়ার গ্রিড লিমিটেড।

অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৩১৫ পয়েন্ট কমে ২০ হাজার ৭০৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। সিএসইতে লেনদেন করা ৩০৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৫টির শেয়ারের দাম বেড়েছে, কমেছে ২৫৭টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। এ বাজারে লেনদেন হয়েছে ৭৪ কোটি ৫৫ লাখ ২০ হাজার ৩৭৮ টাকা। এর আগের লেনদেন হয়েছিল ৬৩ কোটি ৮২ লাখ ৫৮ হাজার ২১১ টাকার শেয়ার। সুত্র: দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ ও দেশ প্রতিক্ষণ ডটকম