শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে সম্প্রতি তালিকাভুক্ত বেশকিছু বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের আইন অমান্য করে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণায় তীব্র অস্থিরতা তৈরি হয়েছে পুঁজিবাজারে। ফলে রবিবার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে এই খাতের শেয়ারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। এছাড়া বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালক আইন অমান্য করে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ফলে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এছাড়া বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএর এক বিধানকে ঘিরে হু হু করে দাম বাড়ার পর বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক লেগেছে। ২০১০ সালে জারি করা আইডিআরএর ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল বিমা কোম্পানিগুলোর ৬০ শতাংশ এবং জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর ৪০ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রাখতে হবে।

বিমার উদ্যোক্তা-পরিচালকদের কোম্পানির শেয়ারের কমপক্ষে ৬০ শতাংশ ধারণে ১০ বছর আগের একটি সিদ্ধান্ত নতুন করে সামনে এনে গত জানুয়ারিতে চিঠি দেয় বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। পরে গত ২০ জুন আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম মোশাররফও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন।

এরপর থেকে বাড়তে থাকে বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম। এই সময়ে বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন একাধিক কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। ইতিমধ্যে অনেকের শেয়ার বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন। ঢাকা ও চিটাগং স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছর বিমা খাতের উদ্যোক্তা পরিচালকরা মোট এক কোটি ১৫ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫০টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা এখনও বলবৎ আছে।

জানা গেছে, বিমা কোম্পানিগুলোর এমন উদ্যোক্তা পরিচালকও আছেন, যিনি তার সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউ কেউ নিজের হাতে থাকা বেশির ভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের বর্তমান শেয়ার ধারণের তথ্য যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।

আর বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওই সিদ্ধান্তের আলোকে শেয়ার বিক্রির ঘোষণার সঙ্গে আইন পরিপালনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) কাছে পরামর্শ চেয়েছে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

রবিবার (১৭ অক্টোবর) ডিএসই, সিএসই ও সিডিবিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে বিষয়টি আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতিকেও অবহিত করা হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের শেয়ার ধারণের বিষয়ে গত ৪ অক্টোবর বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) চিঠি পাঠিয়েছে। সেখানে বিমা আইন, ২০১০ এর ধারা ২১(৩) অনুযায়ী, বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের ৬০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করার বিধান আছে বলে উল্লেখ রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, বিমা কোম্পানির উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের শেয়ার বিক্রির ঘোষণার সঙ্গে আইডিআরএ’র নির্দেশনা পরিপালন নিশ্চিত করার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য উভয় স্টক এক্সচেঞ্জ ও সিডিবিএলকে পরামর্শ দেওয়া হলো।

এর আগে ৪ অক্টোবর বিমা কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের শেয়ার ধারণের তথ্য চেয়ে সিডিবিএলকে চিঠি দেয় আইডিআরএ। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিমা আইন, ২০১০ এর ধারা ২১(৩) তফসিল-১ অনুযায়ী, লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় ন‌্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা এবং নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় ন‌্যূনতম পরিশোধিত মূলধন ৪০ কোটি টাকা।

উভয় ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ার ধারণ ৬০ শতাংশ উদ্যোক্তাদের এবং বাকি ৪০ শতাংশ জনসাধরণের জন্য উন্মুক্ত। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে লক্ষ করা যাচ্ছে, বিমা কোম্পানির পরিচালকরা মূলধনী মুনাফার জন্য শেয়ার বিক্রয়ের ঘোষণা দিচ্ছেন, যা বিমা আইন অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ ও ন‌্যূনতম শেয়ার ধারণের ব্যত্যয়।

অতএব, বিমা কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও জনগণের শেয়ারের পরিমাণ কর্তৃপক্ষকে অতি দ্রুত অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো। আইডিআরএ’র ওই চিঠির আলোকেই বিএসইসি শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার ধারণ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছে।

এদিকে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য মতে, চলতি বছরে বিমা খাতের উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা এসেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি শেয়ার বিক্রি হওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে।

কারা বিক্রি করছেন কত শেয়ার: তথ্যমতে, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক রওশন আরা তার কাছে থাকা কোম্পানির এক লাখ ৪৯ হাজার ৮১০টি শেয়ারের সবগুলোই বিক্রি করবেন। রবিবার দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে তিনি সব শেয়ার বিক্রি করবেন।

মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্সের তিন পরিচালক হাতের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। গত ১৯ আগস্ট পরিচালক মোহাম্মদ আলী আজগর তার কাছে থাকা কোম্পানির দুই লাখ ৮৭ হাজার ৩০২টি শেয়ারের সব বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেন। আরেক উদ্যোক্তা সৈয়দ নূর আলম তার কাছে থাকা এক লাখ ২৩ হাজার ২০০টি শেয়ারের সব বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা দেন। আরেক পরিচালক মাহতাবুদ্দিন চৌধুরীও তার কাছে থাকা কোম্পানির আট লাখ ৯৮ হাজার ৫০৯টি শেয়ারের সব বিক্রি করার ঘোষণা দেন।

একইভাবে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের দুই উদ্যোক্তা এম এ মালেক তার হাতে থাকা ২১ হাজার ৫৭৫টি শেয়ারের সবগুলো আর জয়নাল আবেদন চৌধুরীর হাতে থাকা ১৩ হাজার শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছেন। নিজের হাতে থাকা ১৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮১১টি শেয়ারের সবগুলো ইতিমধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন।

মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক জামালউদ্দিন তার হাতে থাকে ৭১হাজার ৫১২টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন গত ৩০ সেপ্টেম্বর। আরেক পরিচালক যোবায়দা ইসলামও তার হাতে থাকা ৫৯ হাজার ৮১৪টি শেয়ার বিক্রি করে দেবেন বলে জানিয়েছেন।

অন্যদিকে গত ২৯ এপ্রিল রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের করপোরেট উদ্যোক্তা মিনহার ফিশারিজ তার হাতে থাকা ২২ লাখ শেয়ারের সবগুলো ব্লক মার্কেটে বিক্রি করে দেন।

জানা গেছে, যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা শেয়ার বিক্রি করছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রির ঘোষণা এসেছে ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা পরিচালক আবদুল মান্নান ও তার স্ত্রী উম্মে কুলসুম মান্নান তাদের মালিকানাধীন কোম্পানি পেনিনসুলা গার্মেন্টস, সানপ্যাক ইন্ডাস্ট্রিজ ও পাইওনিয়ার ড্রেস লিমিটেডের হাতে থাকা ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্সের বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রথমে ঘোষণা দেওয়া হয় ছয় লাখ ৫৯ হাজার ১২০টি শেয়ার বিক্রির। এই শেয়ার বিক্রি শেষ না হতেই আসে এর চেয়ে চার গুণ বেশি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়।

গত ৩১ আগস্ট ঘোষণা আসে, পেনিনসুলার হাতে থাকা পাঁচ লাখ ২৮ হাজার ৬২২টি শেয়ারের মধ্যে তিন লাখ ১০ হাজার ৭২২টি, সানপ্যাকের হাতে থাকা পাঁচ লাখ ২৮ হাজার ৬৩৩টি শেয়ারের মধ্যে তিন লাখ ১০ হাজার ৭৩৩টি আর পাইওনিয়ার ড্রেসের হাতে থাকা চার লাখ ১৩ হাজার ৯৮৫টি শেয়ারের মধ্যে ৩৭ হাজার ৬৩৫টি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা এসেছে।

গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক মোজাম্মেল হক ও খুরশিদা চৌধুরী গত ৩ আগস্ট বিপুল পরিমাণ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। মোজাম্মেল বিক্রি করবেন ছয় লাখ নয় হাজার ৮৭৮টি ও আর খুরশিদা চৌধুরী বিক্রি করবেন ৫৭ হাজার ৪৬৯টি শেয়ার।

আর ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক আজিজ আল মাহমুদ তার কাছে থাকা কোম্পানির ১৮ লাখ ১৭ হাজার ১২০টি শেয়ারের মধ্যে আট লাখ ১০ হাজার বিক্রির ঘোষণা দেন গত জুলাইয়ে।

অন্যদিকে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের মোট শেয়ারের ৩৮ শতাংশ শেয়ার আছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর কোম্পানির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শফিক তার কাছে থাকা কোম্পানির এক লাখ ৫২ হাজার ৯১৭টি শেয়ারের মধ্যে এক লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন।

একই কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক জয়নাল আবেদিন চৌধুরী গত ১২ সেপ্টেম্বর তার হাতে থাকা ১০ লাখ ৭৭ হাজার ৬৮৭টি শেয়ারের মধ্যে ১৩ হাজার শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছেন।

আবার অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান গত ৬ মে জানিয়েছেন তিনি তার হাতে থাকা কোম্পানিটির সাত লাখ ৫৬ হাজার ১০৭টি শেয়ারের মধ্যে দেড় লাখ বিক্রি করে দেবেন। পরে ৫ জুন তিনি জানান, সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। একই কোম্পানির আরেক উদ্যোক্তা পরিচালক মাহমুদুল হক একই সময়ে তার হাতে থাকা ১০ লাখ ৮০ হাজার শেয়ারের মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন ৩০ হাজার শেয়ার।

গত ৫ সেপ্টেম্বর বিএনআইসিএলের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া তার হাতে থাকা কোম্পানিটির ১২ লাখ শেয়ারের মধ্যে তিন লাখ ১৪ হাজার ১৭৫টি বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ১৯ আগস্ট আরেক উদ্যোক্তা এম এফ কামাল তার হাতে থাকা ১২ লাখ শেয়ারের মধ্যে তিন লাখ ১৪ হাজার ১৭৫টি বিক্রির ঘোষণা দেন। পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালক নাসিরুল্লাহ তার হাতে থাকা দুই লাখ ৩১ হাজার ৩৩২টি শেয়ারের মধ্যে ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন গত ১৪ সেপ্টেম্বর।

পূরবী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক খালিদ হোসেন গত ৭ সেপ্টেম্বর তার হাতে থাকা ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৬টি শেয়ারের মধ্যে এক লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক শাওন আহমেদও তার হাতে থাকা ৩৯ লাখ ১৫ হাজার ৮১৬টি শেয়ারের মধ্যে ৫০ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।