মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, শেয়ারবার্তা ২৪ডটকম, ঢাকা:  অনুমোদিত মূলধন লাফিয়ে বাড়ার পাশাপাশি মাত্রা অতিরিক্ত প্লেসমেন্ট থাকা ও  শেয়ার প্রতি কোম্পানির আয়ে (ইপিএস) কারসাজি, ভুয়া রিটার্ন অন ইক্যুইটি দেখানোর পাশাপাশি কর সমন্বয়ে তথ্যের গরমিলসহ একগুচ্ছ অনিয়মের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে রিংশাইন টেক্সটাইল। প্রসপেক্টাসের পাতায় পাতায় অসঙ্গতি, মুনাফায় মিথ্যা তথ্য এবং গোজামিল আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে আইপিও অনুমোদনের অভিযোগ উঠেছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে।

নানা অভিযোগের পরও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জের নাকের ডগার উপর দিয়ে আইপিও টাকা তুলছে রিংশাইন টেক্সটাইল। এছাড়া রিংশাইন টেক্সটাইল ভূয়া মুনাফা দেখিয়ে প্রতারণার আশ্রয়ে বাজার থেকে হাজার কোটি কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে এবং সরকারের রাজস্ব ফাঁকি বলে অভিযোগ রয়েছে। অনিয়ম জালিয়াতির চিত্র এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ পাওয়া গেছে আইপিও’র মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কোম্পানিটির রয়েছে নানা অনিয়ম। কোম্পানির বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ বিনিযোগকারীদের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এছাড়া বস্ত্র খাতের রিংশাইন টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের অনুমোদিত মূলধন লাফিয়ে বাড়ার পাশাপাশি মাত্রা অতিরিক্ত প্লেসমেন্ট থাকায় কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তেমনি কোম্পানিটি নিয়ে বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও আসার পর এই কোম্পানিটির সকল অপকর্মের ফিরিস্তি বের হতে শুরু করছে। একইভাবে কোম্পানিটির মুনাফা তাদের প্রসপেক্টাস তুলে ধরা হয়েছে এক ধরণের আবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ কর প্রদান করা হয়েছে আরেকভাবে।

এনবিআর সূত্র মতে জানা যায়, ২০১৮ সালে রিংশাইন টেক্সটাইল কোম্পানিটির  ৯ কোটি ৯২ লাখ ৫০ হাজার ৫২ টাকা ট্যাক্স দেখানো হয়েছে। অথচ কর প্রদান করা হয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। একইভাবে প্রতারণা করেছে এর পূর্বের বছর গুলোতেও।

কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোম্পানিটি কর পূর্ববর্তী ট্যাক্স ৬৫ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার ১৬৬ টাকা দেখানো হয়েছে, তবে কোম্পানিটির কর পরবর্তী মুনাফা দেখানো হয় ৫৫ কোটি ৪২ লাখ ৩৭ হাজার ১১৪ টাকা। এই হিসেবে কোম্পানিটির ৯ কোটি ৯২ লাখ ৫০ হাজার ৫২ টাকা ট্যাক্স দেখানো হয়েছে। তবে, এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটি ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ট্যাক্স প্রদান করেন।

কোম্পানিটি ‘প্রসপেক্টাস অনুসারে ২০১৩ সালে রিং শাইন টেক্সটাইলের মূলধন ছিল ১৩৭ কোটি ২৩ লাখ ৪২ হাজার ২০০ টাকা। এরপর প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ১৪৭ কোটি ৮২ লাখ ৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। এখন আবারও নতুন করে আইপিওর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পেলো কোম্পানিটি।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন হলো- ১৩৭ কোটি টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া কোম্পানির প্লেসমেন্টের মাধ্যমে প্রায় ১৪৮ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার পর ১৫০ কোটি টাকাসহ মোট ২৯৭ কোটি ৮২ লাখ ৬ হাজার উত্তোলনের অনুমোদন পেল কিভাবে?’ ‘অন্যান্য কোম্পানির মতোই যদি এই প্লেসমেন্ট শেয়ার তারা ৩০-৪০ টাকা করে বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় তাহলে মার্কেট থেকে অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকা উধাও হয়ে যাবে।’

পুঁজিবাজারের ক্রান্তিকালে নতুন করে বিশাল এই অর্থ ইস্যুয়ার কোম্পানির পকেটে চলে গেলে এই টাকা কখনো আর বাজারে আসবে না। কোম্পানির প্রসপেক্টাসের ৩১৭ পৃষ্ঠায় (কম্পারিজন রেশিও উইথ দ্যা ইন্ডাস্ট্রিজ এভারেজ অফ দ্যা সেইম পিরিয়ড) কোম্পানি নিজেই স্বীকার করে নিচ্ছে, তাদের বর্তমান অবস্থার অনেক কিছুই ‘ইন্ডাস্ট্রিজ এভারেজ’ থেকে অনেক কম।’এখন পুঁজিবাজারে দুর্দশা চলছে। বিশেষ করে টেক্সটাইলের অবস্থা সবচাইতে করুণ। এই দুর্দশার মধ্যে কীভাবে কোম্পানিটি শুধু আইপিওর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন পেল।

এছাড়া কোম্পানিটির ভুল রিটার্ন অন ইক্যুইটি দেখিয়ে আসছে। বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্স অনুসারে, মুনাফাকে গড় ইক্যুইটি দিয়ে ভাগ করে রিটার্ন অন ইক্যুইটি দেখাতে হয়। কিন্তু রিংশাইন কর্তৃপক্ষ বছর শেষের ইক্যুইটি দিয়ে রিটার্ন অন ইক্যুইটি নির্ণয় করে। যা কোম্পানির প্রকৃত চিত্র দেখায় না।

বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (বিএএস)  নিয়ম অনুসারে, রিস্টেট ইপিএস বলতে মোট শেয়ার দিয়ে মুনাফাকে ভাগ করে হিসাব করা। কিন্তু রিং শাইন টেক্সটাইল কর্তৃপক্ষ ওয়েটেড শেয়ার দিয়ে ২০১৩- ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে রিস্টেড ইপিএস দেখিয়েছে। যাতে রিস্টেড ইপিএস বেশি দেখানো হয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, একটি অতি দূর্বল মৌলের কোম্পানি রিংশাইন কারসাজিপূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ভালো আর্থিক অবস্থা দেখিয়ে আইপিওতে এসেছে। এর আগে কোম্পানিটি প্লেসমেন্টের মাধ্যমেও বড় অংকের টাকা সংগ্রহ করেছে। কোম্পানিটির প্রকৃত অবস্থা যা তাতে তালিকাভুক্তির কয়েক বছরের মধ্যেই এটি রুগ্ন কোম্পানির তালিকায় নাম লেখাবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। এতে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

অর্থনীতিবিদ ও বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. এ. বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলনের লক্ষ্যে অনেক কোম্পানি আইপিওতে এক-দুই বছর আগে থেকে কৃত্রিমভাবে মুনাফা বাড়িয়ে দেখায়। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধে ৫ থেকে ১০ বছরের আর্থিক হিসাব পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

এ বিষয় কোম্পানির সচিব আশরাফ আলীর কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বলেছেন, বিধি মোতাবেক সব হয়েছে।