শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের বিরুদ্ধে পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও বিমা দাবির অর্থ পরিশোধ না করার অভিযোগ উঠেছে। কারও দুই বছর, কারও পাঁচ বছর আবার কারও আট বছর পার হলেও সমুদয় অর্থ ফেরত না পেয়ে দুর্বিষহ জীবন পার করছেন অনেক গ্রাহক। কোথাও কোনো প্রতিকার না পেয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা শেষ ভরসা হিসেবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে বিমা দাবির অর্থ ফেরত পাওয়ার আশায় অভিযোগ করেন।

জানা গেছে, সারাদেশ থেকে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির কাছে পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে ১৮ হাজার ৯৩৩টি পলিসি না দেওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইডিআরএ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে ডেকে গ্রাহকদের বিমা দাবিগুলো পরিশোধ করতে নির্দেশ দিয়েছে। যদিও পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষের দাবি, ইতোমধ্যে তারা অধিকাংশ বিমা দাবির অর্থ পরিশোধ করেছে। বাকিগুলো প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৮ হাজার ৯৩৩টি পলিসির দাবি পরিশোধ করেনি। বিমা দাবির অর্থের অঙ্কও বেশ, প্রায় ২৮ কোটি ৬৫ লাখ ১৩ হাজার ৩০৬ টাকা। তবে কোম্পানিটির দাবি, ইতোমধ্যে তারা ১১ হাজারের বেশি বিমা দাবি অর্থাৎ সাড়ে ১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

বিমা আইন অনুযায়ী, পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করতে হবে। যদি কোনো কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে বর্তমান ব্যাংকের সুদের চেয়ে বেশি হারে বিমা দাবির সুদ দিতে হয়। কিন্তু পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর বিমা দাবির অর্থ আটকে রেখেছে— অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

নীলফামারীর সৈয়দপুরের বিস্কুট বেকারির কর্মচারী মজিবর রহমান। ভুক্তভোগী এ গ্রাহক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একসঙ্গে মুনাফাসহ আসল পাব এ আশায় প্রতি মাসে ২০০ টাকা কিস্তির ক্ষুদ্র সঞ্চয় বিমা করি পদ্মা লাইফে। ২০১৭ সালে বিমার মেয়াদ শেষ হয়। তারপর থেকে টাকার জন্য রংপুর, ঢাকা, নীলফামারী— তিন অফিসের স্যারদের পেছনে দৌড়াচ্ছি, কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। তিন সন্তান আর আমরা দুজন; পাঁচজনের সংসারে আশা করেছিলাম জমানো টাকা দিয়ে কিছু একটা করব। কিন্তু তারা টাকা দিচ্ছে না।’

বিমা করার সময় পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রতিনিধি বলেছিল, মেয়াদ শেষে মুনাফাসহ দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর পর মুনাফা তো দূরের কথা আসল টাকাও এখন ফেরত পাচ্ছি না। কোম্পানিতে বিমা দাবির টাকা চাইতে গেলে নানাভাবে হয়রানি করে। একই অবস্থা সৈয়দপুরের ভ্যানচালক মো. জসিম উদ্দিনের। তার চেয়েও খারাপ সময় পার করতে হচ্ছে বিধবা মারুফা আক্তারের। চার সন্তানের এ জননী অন্যের বাড়িতে কাজ করে খান। কাজ না করলে ভাত জোটে না, অভুক্ত থাকে সন্তানরা। এমন অনেক বিধবা নারী ও দিনমজুরসহ প্রায় ১৯ হাজার হতদরিদ্র মানুষের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করছে না পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

২০১৮ সালে তিনটি বিমার মেয়াদ পূর্ণ হয় চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার নারায়ণপুর চাপাতলী গ্রামের বাসিন্দা নাছির মিয়ার। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার দুই বছর পার হলেও দাবির টাকা পাননি তিনি। বিমা দাবির টাকা পেতে প্রতিষ্ঠানটিতে দিনের পর দিন ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

নাছির মিয়া বলেন, বিমা করার সময় পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রতিনিধি বলেছিল, মেয়াদ শেষে মুনাফাসহ দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই বছর পর মুনাফা তো দূরের কথা আসল টাকাও এখন ফেরত পাচ্ছি না।

কোম্পানিতে বিমা দাবির টাকা চাইতে গেলে নানাভাবে হয়রানি করে। ‘আমরা গরিব মানুষ, কষ্টের সংসার। তারপরও নিয়মিত বিমার প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিয়েছি। মেয়াদ শেষে টাকা চাইলে কোম্পানির প্রতিনিধিরা সব কাগজপত্র নিয়ে নেয়। দেব-দিচ্ছি বলে মাস, মাসের পর বছর পার করে দেয়। কিন্তু বিমা দাবির টাকা আর দেয় না।’

পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছে মোট কত টাকা পাওনা— জানতে চাইলে ভুক্তভোগী এ বিমা গ্রাহক বলেন, তিনটি বিমার একটিতে ৫৩ হাজার, একটিতে ৬৫ হাজার এবং একটিতে পাঁচ লাখ ৮৫০ টাকা রয়েছে। মোট পাওনা ছয় লাখ আট হাজার ৮৫০ টাকা। আজ দুই বছর হতে চলল কোনো টাকা তারা দিল না। অথচ, অনেক আশা নিয়ে বিমা করেছিলাম।

নাছির মিয়ার মতো চাঁদপুর জেলা শাখার কার্যালয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষ বিমার টাকা নিতে ভিড় জমান। কিন্তু সেখানে এসে দায়িত্বরত কাউকে না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। শুধু চাঁদপুর বা সৈয়দপুর নয়, সারাদেশ থেকে পদ্মা ইসলামী লাইফের বিরুদ্ধে বিমা দাবি পরিশোধ না করার অভিযোগ উঠেছে।

আইডিআরএ’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৮ হাজার ৯৩৩টি পলিসির দাবি পরিশোধ করেনি। গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তারা এ সংখ্যা পেয়েছে। বিমা দাবির অর্থের অঙ্কও বেশ, প্রায় ২৮ কোটি ৬৫ লাখ ১৩ হাজার ৩০৬ টাকা। তবে কোম্পানিটির দাবি, ইতোমধ্যে তারা ১১ হাজারের বেশি বিমা দাবি অর্থাৎ সাড়ে ১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ম্যাচিউরড হওয়ার পরও বছরের পর বছর পলিসির দাবিগুলো পরিশোধ করা হচ্ছে না সারাদেশ থেকে এমন অসংখ্য অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। পদ্মা ইসলামী লাইফের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে আমরা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। দ্রুত বিমা দাবি পরিশোধ করতে তাদের নির্দেশনা দিয়েছি।

পদ্মা ইসলামী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এ কে এম শরীফুল ইসলামও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, অল্প সময় ধরে সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ঘটনাগুলো বেশ আগের। করোনার কারণে বিমা দাবিগুলো পরিশোধে সমস্যা হয়েছে। এখন আটকে থাকা বিমা দাবিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করা অধিকাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেছি। বাকিগুলো পরিশোধের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে যোগ করেন শরীফুল ইসলাম।

সময় মতো বিমা দাবির অর্থ পরিশোধ না করা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ— উল্লেখ করে বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির বলেন, ‘কিছু বিমা কোম্পানির জন্য আমাদের সবার দুর্নাম হচ্ছে। আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। যেহেতু বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ এসেছে, অবশ্যই তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবে; আশা করছি।’

গত রোববার (৩ অক্টোবর) আইডিআরএ বরাবর পাঠানো পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও শরীফুল ইসলাম ও ম্যানেজার (কাস্টমার সার্ভিস) রাইসুল আলম চৌধুরীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, অভিযোগ ওঠা ১৮ হাজার ৯৩৩টি পলিসির মধ্যে ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ হাজার ২৬টি। এসব দাবির বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে ১৭ কোটি ৫০ লাখ ৩৩ হাজার ৪০৮ টাকা। বিমা দাবির ইস্যু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এক হাজার ৮১৬টি, টাকার অঙ্কে তিন কোটি ৭৬ লাখ ৩৬ হাজার ২২২ টাকা।

বিমা কোম্পানিটির হিসাব বিভাগে বিমা দাবি পরিশোধের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এক হাজার ২৯৩টি পলিসি, টাকার অঙ্কে এক কোটি ৪৭ লাখ ৬৪ হাজার ৯৭১ টাকা। গ্রাহকদের কাছ থেকে নির্বাহী রশিদ জমা হয়নি এমন পলিসির সংখ্যা দুই হাজার ২৩০টি, টাকার অঙ্কে তিন কোটি ১১ লাখ ২২ হাজার ৬৫ টাকা।

চিঠিতে আরও বলা হয়, নির্বাহী রশিদ ইস্যু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এক হাজার তিনটি, টাকার অঙ্কে এক কোটি ৯৭ লাখ ১৪ হাজার ৫৭৫ টাকা। পলিসি সঠিক নয় এমন দাবি রয়েছে এক হাজার ৪৬১টি, টাকার অঙ্কে ৬৯ লাখ ৭১ হাজার ২৮৯ টাকা। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি ৭৬ হাজার ৯০৭ টাকার ২২টি পলিসি। বাতিল হয়েছে দুই লাখ ৯৩ হাজার ৫২০ টাকার ২৪টি পলিসি এবং চাহিদা প্রেরণের পদ্ধতিতে রয়েছে নয় লাখ ৩৪৯ টাকার ৫৮টি পলিসি।