শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা:  নানা জল্পনা কল্পনা অবসান ঘটে অবশেষে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা সমন্বয়ের সময় বাড়ল ৬ মাস। আগামী ৩১ মার্চের পরিবর্তে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা সাড়ে ৮৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে নতুন সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে সাধুবাদ জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। এর ফলে ব্যাংকারদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছেন তারা। তবে ব্যাংকারদের মধ্যে স্বস্তি এলেও বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে প্রশ্নের মুখে পড়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কারণ, একই সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃতীয় দফা সংশোধনীর মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো সার্কুলার জারি করা হলো। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কোনো সিদ্ধান্ত চাপানোর আগে এর প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও ব্যাংকারদের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে।

তাদের প্রশ্ন, বিনিয়োগসীমা কেনই বা কমানো হয়েছিল, আবার কেনই বা কার্যকারিতার সময়সীমা বার বার পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর চেয়ে বিনিয়োগসীমা আগের অবস্থানেই রাখা ভালো ছিল।

ব্যাংকারদের শীর্ষ সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত সময়োপযাগী হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা জারি করার গত ১৪ মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলো যে ঋণ দিয়েছিল তা আদায় না হওয়ায় পুঞ্জীভূত খেলাপিঋণ বেড়ে গেছে।

কিন্তু এ সময়ে আমানতপ্রবাহ বাড়েনি, বরং কমে গেছে। এর বাইরে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের নীতিমালা সংশোধন হওয়ায় বাড়তি চাপে পড়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত সময়ে বিনিয়োগ সমন্বয় করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। তিনি বলেন, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করব বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তিত সময়সীমার মধ্যেই তা সমন্বয় করার।

তবে অপর এক ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, ব্যাংক পরিচালকদের চাপে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদহার রয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ। ফলে ব্যাংকে সুদহার কমে যাওয়ায় সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন।

নতুন করে আমানত তো রাখেননি, বরং বিদ্যমান আমানতও কেউ কেউ তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। এর বাইরে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির ফলে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে অনেকটা আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। এর প্রভাবেও আমানত কমে গেছে।

কিন্তু ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় সুদাসলে তা খেলাপি ঋণ হয়ে সামগ্রিক ঋণ বেড়ে গেছে। এর ফলে বিনিয়োগসীমা অনেকেই সাড়ে ৮৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনতে পারেনি। ইতোমধ্যে ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেক ব্যাংক এ সঙ্কট মেটানোর জন্য কলমানি মার্কেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। কেউবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিচ্ছে। এর ওপর মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দিয়েছে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের নতুন সার্কুলার।

নতুন সার্কুলার অনুযায়ী অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তার বিপরীতে সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণ করতে হবে। এতে ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। অপর দিকে চাহিদার চেয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোতে ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

এ সঙ্কট মেটাতে স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো। সবমিলেই দেশের ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগসীমা সমন্বয়ের সময় ৬ মাস বাড়ানোর ফলে ব্যাংকারদের মধ্যে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও তারা স্বস্তিতে থাকতে পারবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনার ১৫ মাসের সময়সীমা শেষ হচ্ছিল চলতি মাসে। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানতের অনুপাত ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা ছিল। গত জানুয়ারিতে ১১টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া বিনিয়োগসীমার বাইরে ছিল। কিন্তু গত ফেব্রæয়ারিতে তা বেড়ে ১৭টিতে দাঁড়ায়। ব্যাংকগুলোর কথা ভেবেই সময় বাড়ানো হয়েছে।

তৃতীয় দফা সার্কুলার সংশোধন : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের শেষ দিকে যখন এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন ব্যাংকিং খাতে ঋণপ্রবাহ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিল। তখন বাস্তবে বিনিয়োগ চোখে না পড়লেও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। আগ্রাসী এ ব্যাংকিংয়ের কারণে ঋণ আমানতের অনুপাত কোনো কোনো ব্যাংকের শতভাগ ছেড়ে যায়। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে ৮৫ ভাগ।

ব্যাংকগুলোর এমন আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। দীর্ঘ দিন ধরে আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১০ শতাংশের নিচে। সাধারণত ঋণের প্রবৃদ্ধি আমানতের চেয়ে কম হওয়ার কথা, সেখানে আমানতের প্রবৃদ্ধির চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়ে যায়।

তহবিল ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আগেই ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোর জন্য এ বিষয়ে এক সার্কুলার জারি করা হয়। বলা হয়, ঋণ আমানতের অনুপাত প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে ৮৫ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৮৩ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশের পরিবর্তে ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এর জন্য সময় দেয়া হয় প্রথম ৬ মাস।

অর্থাৎ যেসব ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ থাকবে তাদেরকে গত বছরের ৩০ জুনের মধ্যে পুননির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে বলা হয়। কিন্তু ব্যাংকের ব্যবসায়ী পরিচালকদের চাপের মুখে গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারী সার্কুলার দিয়ে সময়সীমা ৬ মাস বাড়ানো হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালনের সময়সীমা ৬ মাস থেকে বাড়িয়ে ১২ মাস করা হয়। কিন্তু এতেও ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট না হয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন।

ব্যাংকের ব্যবসায়ী পরিচালকরা হোটেল সোনারগাঁওয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরকে নিয়ে এক বৈঠকের আয়োজন করে। ওই বৈঠকের পর গত বছরের ৯ এপ্রিল আবারো সার্কুলার সংশোধন করে বিনিয়োগসীমা সমন্বয়ের সময় আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩১ মার্চ করা হয়, যা চলতি মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু আলোচ্য সময়েও তা সমন্বয় করতে না পারায় বিনিয়োগসীমা নিয়ে তৃতীয় দফা সংশোধনের মাধ্যমে চতুর্থ দফা সংশোধন করল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের মহাব্যবস্থাপক মো: রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সার্কুলারে বিনিয়োগসীমা সমন্বয়ের সময়সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর করা হয়েছে।

সাধারণ ব্যাংকারদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া হলে ব্যাংকগুলো তা বিনা বাক্যে বাস্তবায়ন করবে এটাই নিয়ম। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক।