শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা:  স্বাভাবিক উত্থান পতনের মধ্য দিয়েই বাজার আরও ভালো হবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে বিশ্বাস রাখতে হবে। বিশ্বাস এবং ধৈর্য্যের সঙ্গে বিনিয়োগ করলে বিনিযোগকারী লোকসানের মুখে পড়বেন না। বাজার ধসের পর যারা ধৈর্য্য ধরেছিলেন কেবল মাত্র তারাই এখন ফল পেতে শুরু করেছেন। কেননা বাজার কয়েকমাস যাবৎই উত্থান পতনের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। তাই নির্বাচনের পর পুঁজিবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

তাই বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য “এখন আকর্ষণীয়” সময়। বাজার মূলধনের ভিত্তিতে দেশের জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান কম হলেও ডিভিডেন্ড ইয়েল্ডে (লভ্যাংশ প্রদানে) এবং মূল্য আয় অনুপাতে (পিই রেশিও) দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগের উপযোগী অবস্থানে রয়েছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করছেন বাংলাদেশ ব্যাংক।

তেমনি দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য পুঁজিবাজার অত্যন্ত আকর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন শিল্পকারখানার জন্য অর্থায়নে পুঁজিবাজার আদর্শ বিকল্প উৎস হতে পারে। তাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উত্তম সময়। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে কেউ বিনিয়োগ করলে লোকসানের সম্ভাবনা খুবই কম। তেমনি পুঁজিবাজার সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে।

বাজার বিশ্লেষক হাসান মাহমুদ বিপ্লব বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে টার্নওভার ও মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের দাম তেমন বাড়ছে না, কিন্তু স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন কথা হচ্ছে যে, যখন পুঁজিবাজার নি¤œগতিতে থাকে, তখন স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পায়।

আর এটা হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ এটি শুধু এদেশের ক্ষেত্রে নয়, অন্য দেশেও হয়ে থাকে। এখানে আরেকটি কারণ হচ্ছে, যেহেতু মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারে কোনো পরিবর্তন আসছে না, তাই স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দিকে বিনিয়োগকারীরা বেশি ঝুঁকছে, কারণ এখানে কিছু না কিছু লাভ করছে। নির্বাচনের আগে স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম এ রকম ওঠানামা করবে। তবে নির্বাচনের পর পুঁজিবাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

বিনিয়োগকারীর উদ্দেশে তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম, ইল্ড, পিই রেশিও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এই সময়ে দীর্ঘমেয়াদে ওইসব কোম্পানির শেয়ার কিনে রাখলে ভালো একটি লাভ পাওয়া যাবে। আর যারা ডে ট্রেডিং করে তাদের অবশ্যই শেয়ার কেনার আগে জেনে-বুঝে এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে ওইসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে। কারণ টাকা বিনিয়োগকারীর। লাভ-ক্ষতি বিনিয়োগকারীকে বহন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজারে যখন গ্রামীণফোন অন্তর্ভুক্ত হয় তখন নতুন অনেক দেশি এবং বিদেশি বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করেছে এবং বাজার মূলধনও বেড়েছিল। তখন গ্রামীণফোন দেশের পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সিএনএন, বিবিসি ও টাইম ম্যাগাজিনে খবর প্রচার করা হয়েছিল। আসলে এটা দেশের পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক।

এখন কথা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, বেশিরভাগই স্বল্প মূলধনি। তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কোম্পানি ছিল না। তাই পুঁজিবাজারকে ভালো অবস্থানে নিতে হলে আরও দেশি এবং বহুজাতিক কোম্পানিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যদি গ্রামীণফোনের মতো ইউনিলিভার কোম্পানিকে দেশের পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেক্ষেত্রে আরও অনেক বিনিয়োগকারী আসবে এবং বাজারের মূলধন বাড়বে।

আমার স্টক ডটকমের সিইও মুহাম্মদ আল জাহাঙ্গীর বলেন, পুঁজিবাজারে মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের তুলনায় স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার বর্তমানে যে টার্নওভার, তা যদি আরও কমে যায় তাহলে স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম আরও বেড়ে যাবে। কারণ ওইসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে বেশি টাকা লাগে না। যেহেতু প্রতিদিনই বিনিয়োগকারী লাভ পাচ্ছে, তাই স্বল্প মূলধনি কোম্পানির দিকে বেশি ঝুঁকছে।

তিনি আরও বলেন, যখন স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে, তখন কারসাজি চক্র বেড়ে যায়। শুধু এদেশের পুঁজিবাজারে নয়, অন্য দেশের পুঁজিবাজারেও কারসাজি চক্র বেড়ে যায়। তবে এটি সাময়িক সময়ের জন্য। ২০১০ ও ২০১১ সালে পুঁজিবাজার ধসের পর লাভ-লোকসান যাই হোক বিনিয়োগকারীরা এখনও পুঁজিবাজারে রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারী ধরে রাখতে হলে ভালো কোম্পানি আনার বিকল্প নেই।

শ্যামল ইকুইটি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে আস্থার অভাব বিষয়টি একেবারেই ঠিক নয়। কারণ ২০১০ এরপর থেকে পুঁজিবাজারে যে সংস্কারের দরকার ছিল তা অনেক হয়েছে। কাজেই এখন আস্থার খুব একটা অভাব নেই। বর্তমানে বাজারে দেখে শুনে বিনিয়োগ করতে পারলে প্রফিট সংগ্রহ করা সহজ। আমরা অনেকেই ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করি। যখন সময় এবং শেয়ার দর সঙ্গতিপূর্ণ হবে না তখন ভুল হবেই। এটি স্বাভাবিক ব্যাপার।

সুতরাং সময় এবং পণ্যের দর বিচার বিশ্লেষণ করে যদি বিনিয়োগ করতে পারি তাহলে পুঁজিবাজার থেকে লোকসান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই আমি মনে করি, এখনই দেখেশুনে বিনিয়োগ করার উত্তম সময়। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারের জন্য তেমন কোনো নেতিবাচক খবর নেই।

কিন্তু তারপরও ক্যাপিটাল মার্কেটে কেন বিনিয়োগ হচ্ছে না, সেটিই আসলে চিন্তার বিষয়। ব্যাংকের লভ্যাংশ ও সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশের পরিমাণ কমে গেছে সেদিক বিবেচনায় সঞ্চিত অর্থটি পুঁজিবাজারে আসার কথা। তারপরও আসছে না। এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয় আমাদের কর্ম দক্ষতার অভাব রয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতি নির্ধারক মহলেও কিছু গাফিলতি আছে বলে মনে হয়। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কিছু দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু বিএসইসির একার পক্ষে বাজার ঠিক করা সম্ভব নয়। ক্যাপিটাল মার্কেট স্বাভাবিক করতে হলে সবার সমন্বিত চেষ্টা থাকতে হবে। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। পুঁজিবাজার গতিশীল হলে দেশের অর্থনীতিও গতিশীল হবে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সেচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দিন আলী আহমেদ বলেন, এখন বিক্রির সময় নয়, বরং পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের এটিই উত্তম সময়। অনেক ভাল কোম্পানির শেয়ারের দাম হ্রাস পেয়ে এখন হাতের নাগালে। বিনিয়োগকারীদের উচিত অস্থির না হয়ে অপেক্ষা করা।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান এম খাইরুল হোসেন বলেন, “বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় সময়। বাংলাদেশের শেয়ারের দর বিবেচনা করে, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে যে হারে মুনাফা করা যায় তার মাত্রা দেখে এবং বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের আইন কানুন যে পরিবর্তন হয়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশের ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।”

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উত্তম সময়, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করলে বড় লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সব মহলে সজাগ। পৃথিবীর সবদেশেই পুঁজিবাজারে কিছু সমস্যা হয়। আমাদের দেশেও হয়। কিছুদিন আগেও পুঁজিবাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তবে সেটা আশঙ্কাজনক না। এখন পুঁজিবাজার সুষ্ঠভাবে চলছে। এমতাবস্থায় বিনিয়োগ করলে বড় ক্ষতি হবে না।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য এখনই সেরা সময়। তাই অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগেই অধিক মুনাফা করা সম্ভব। যথাযথ প্রচার-প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব বলে তারা মনে করেন।

এদিকে, শেয়ারপ্রতি মূল্য আয় অনুপাতের (পিই রেশিও) বিচারেও উপমহাদেশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী। ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের তুলনায় বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের পিই রেশিও কম অর্থাৎ বাজার পরিস্থিতি অধিক বিনিয়োগ উপযোগী।