sharudফয়সাল মেহেদী, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মূল্য আয়ের অনুপাত বা পিই রেশিও রয়েছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। তবুও থেমে নেই শেয়ারের দর বৃদ্ধির প্রবণতা। শেয়ার দর যতই বাড়ছে বিনিয়োগ ঝুঁকির প্রবণতাও ততই বাড়ছে। বর্তমান এ চিত্র পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের। সম্প্রতি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করারও অভিযোগ ওঠে।

তাছাড়া উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনাও আমলে নিচ্ছে না প্রকৌশল খাতের কোম্পানি। ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের লেনদেনে শুরু হয়। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর শেয়ারটির দর ছিলো ৩৪.১০ টাকা।

যা বিগত দুই বছরের মধ্যে শেয়ারটির সর্বোচ্চ দর। বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল শেয়ার দর দাঁড়ায় ১০.১০ টাকায়। তবে এর পরের কার্যদিবস থেকে শেয়ার দর আরও কমে ফেস-ভ্যালুর নিচে নেমে যায়। অবশ্য এর পরে একাধিকবার ফেসভ্যালুতে ফিরলেও তা স্থায়ী হয়নি। বরং ২২ আগস্ট থেকে ফেস-ভ্যালুর নিচেই লেনদেন হচ্ছে কোম্পানিটির শেয়ার দর।

এদিকে ২১ নভেম্বর থেকে হঠাৎ করে শেয়ারটির দর ধারাবাহিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। শেয়ারটির দর ২০ নভেম্বর ছিলো ৮.৩০ টাকা। তবে পরবর্তী কার্যদিবস থেকে শেয়ার দর টানা বেড়ে ৯.৫০ টাকায় উঠে আসে। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে (২৪ নভেম্বর পর্যন্ত) শেয়ারটির দর বেড়েছে ১৪.৪৬ শতাংশ বা ১.২০ টাকা।

সর্বশেষ কার্যদিবসে শেয়ার দর আগের কার্যদিবসের তুলনায় ২.১৩ শতাংশ বা ০.২০ টাকা বেড়ে সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৯.৬০ টাকা দরে। শেয়ার দর বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্য আয়ের অনুপাত বা পিই রেশিও ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে।

গত ১৭ নভেম্বর পিই রেশিও ছিলো ২১০ পয়েন্টে; যা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২৪ নভেম্বর দাঁড়িয়েছে ২৩৭.৫০ পয়েন্টে। বর্তমান এ পিই রেশিও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, বিশেষজ্ঞরা ২০-এর বেশি পিই রেশিওর কোম্পানিকে বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করে থাকেন।

আর যে কোম্পানির পিই রেশিও ৪০-এর উপরে সেগুলোতে বিনিয়োগের জন্য মার্জিন ঋণ প্রদানে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিশেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থাৎ বিনিয়োগের জন্য ওই কোম্পানিগুলোকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা লঙ্ঘন : উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার ধারণ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা লঙ্গন করে ব্যবসা চালাচ্ছে সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ। বিএসইসির পক্ষ থেকে বারবার উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারনের নির্দেশনা দেয়া হলেও তার কোন পরোয়াই করছেন না এ কোম্পানিটি।

উল্টো নিজেদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে যাচ্ছেন। ৩০ জুন ২০১৫ শেষে কোম্পানির পরিচালকদের হাতে ৩২.৬২ শতাংশ শেয়ার থাকলেও ৩১ অক্টোবর ২০১৬’এ তা ৯.৪১ শতাংশে নেমে এসেছে।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর বিএসইসির ধারা ২সিসি অর্পিত ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ (১৯৬৯ এক্সবিবিআই) প্রজ্ঞাপন জারিতে বলা হয় পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্য-বাধকতা পূরণ করতে হবে। তারপরেও কোম্পানিটি তা পরিপালন না করে ব্যবসা করছে।

হতাশ বিনিয়োগকারীরা : তালিকাভুক্তির প্রথম বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্টক ডিভিডেন্ড নামক কাগজ ধরিয়ে দিলেও পরের বছরেই বিনিয়োগকারীদের হতাশ করে এ কোম্পানিটি। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানিটি ১৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষনা করে। ওই বছর ২০১৪ সালে কোম্পানিটি ৫ কোটি ১৩ লাখ মুনাফা করে। এরপরের বছরেই অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৩০ জুনে সমাপ্ত হিসাব বছরে কোম্পানিটি ‘নো’ ডিভিডেন্ড দিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশ করে। সমাপ্ত অর্থবছরে ১৭ লাখ টাকা লোকসান দেয়।

আলোচিত সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসানের পরিমাণ দাড়ায় ০.০৩ টাকায়।  এদিকে ৩০ জুন’ ১৬ সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ০.০৪ টাকা। ফলে আলোচ্য বছরেও ‘নো’ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে।

ফলে বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহে শেয়ার দর ফেস-ভ্যালুর নিচে অবস্থান করে। দীর্ঘ দিন ধরে শেয়ার দর ফেস-ভ্যালুর নিচে থাকায় এবং বছর শেষে ‘নো’ দেয়ায় ফেঁসে গেছেন কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীরা।

সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর’১৬) কোম্পানিটি লোকসান থেকে মুনাফায় ফিরেছে। প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ০.০১ টাকা। যা আগের বছর একই সময় ছিল ০.০১ টাকা (নেগেটিভ)।

আরও যত অভিযোগ : কোম্পানিটি আইপিও আবেদন করার আগে প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানির মূলধন বৃদ্ধি করেছে বলে জানা গেছে। আইপিও আবেদন করার আগে কোম্পানিটি ২৪৫ জনের কাছে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট মোট ২৪ কোটি ৩৪ লাখ ৭১ হাজার ১০০ টাকার শেয়ার বিক্রি করে মূলধন বৃদ্ধি করে। এর আগে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডারদের মোট শেয়ারের মূল্য ছিল ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। যার কারণে কোম্পানিটি আবেদেনের আগে ২৮ কোটি টাকা লেনদেন দেখায়।

কিন্তু যখনই কোম্পানিটি আইপিও’র অনুমোদন পায় সাথে সাথে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকগণ তাদের হাতে থাকা শেয়ার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তালিকাভুক্ত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে যা ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসে যা বিএসইসির আইন লঙ্ঘন।

২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রসপেক্টাসে কোম্পানিটির ৯ জন উদ্যোক্তা ও পরিচালকের তালিকা দেয়া হয়েছে। যাদের শেয়ার তিন বছরের জন্য লক-ইন থাকবে।

২০১৪ সালে মোট ১৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড দেয়। আর এ নিয়ে অনেকেই শেয়ার বিক্রয় করে কোম্পানি থেকে সরে যায়। কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের যে কোন শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে ঘোষণা দিতে হয়। কিন্তু কোম্পানির কোন উদ্যোক্তা ও পরিচালক ঘোষণা না দিয়েই শেয়ার বিক্রির করে দেয়।

সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কোম্পানি সচিব এস কে সাহা জানান, ২০১৪ সালে নির্দিষ্ট সময়ে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত করতে না পারায় কোম্পানির এলসি আটকে যায়।

এমনকি প্রায় ৮ মাস এলসি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পিভিসি উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য অনেক গ্রাহককে ঠিকমত করে পন্য সরবরাহ করা যায়নি। যার জন্য কোম্পানির অনেক লোকসান হয়।

তাছাড়া উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় মেশিনগুলোতে মরিচা পরে এবং মেইন ডিসি মোটর নষ্ট হয়ে যায়। বিদেশ থেকে কিছু পার্টস আমদানি করতে হয়। এতে কোম্পানির ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। তাই গত ২ বছর ধরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ডে দিকে পারছে না।

এ বিষয়ে বিএসইসি’র নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, যেসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ৩০ শতাংশের নিচে তাদের তালিকা দেওয়ার জন্য ঢাকা স্টক একচেঞ্জে (ডিএসই) একটি চিঠি দিয়েছি আমরা। যে কতোগুলো কোম্পানি আইন পরিপালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, যেসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেনি বা শেয়ার ধারন করতে পারছে না তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তাছাড়া যারা এ আইন মানবে না কমিশন তাদের মূলধন বাড়ানোর অনুমোদনও দিবে না বলে জানান তিনি।