চট্টগ্রাম ব্যুরো, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিবিধ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) বহরে প্রায় সাড়ে ৯শ কোটি টাকা ব্যয়ে দুইটি নতুন জাহাজ যুক্ত হচ্ছে। তবে গত বছরের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানটি ৬টি জাহাজ ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফলে দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বিএসসি নিজস্ব অর্থায়নে জাহাজ কিনতে যাচ্ছে। জাহাজ কেনার ব্যাপারে ইতোমধ্যে বিএসসি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। গত সোমবার সম্পন্ন হয়েছে প্রিবিড মিটিং।

আগামী বছরের শুরুতেই এই দুইটি জাহাজ বহরে যুক্ত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তিনটি জাহাজ কেনার ছয় বছর পর আবারো বিএসসি দুইটি জাহাজ কিনছে। এর আগে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত দুইটি অয়েল ট্যাংকার স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এখন নতুন করে যে দুইটি জাহাজ কেনা হচ্ছে সেগুলো বাল্ক ক্যারিয়ার বলেও বিএসসি জানিয়েছে।

বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর মাহমুদুল মালেক জানান, আমরা নিজস্ব অর্থায়নে দুটি জাহাজ কিনছি। নানাভাবে জাহাজ কেনার অর্থায়নের হিসেব নিকেশ করেছি। দেখলাম, ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রাখার চেয়ে জাহাজ কেনা ভালো। তাই বিএসরি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজস্ব অর্থায়নে জাহাজ কেনার জন্য আমরা গত ৪ জুন থেকে দরপত্র বিক্রি শুরু করেছি। ১৫ জুলাই পর্যন্ত দরপত্র গ্রহণ করা হবে এবং ১৬ জুলাই দরপত্র খোলা হবে। এরপরই মূল্যায়ন করে আমরা অগাস্টের মধ্যে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। ইতোমধ্যে আমরা প্রিবিড মিটিং করেছি। আশা করছি ১৮টির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেবে।

তিনি আরো বলেন, দরপত্রে আমরা শর্ত দিয়েছি যারা কার্যাদেশ পাবেন, তাদেরকে চুক্তি স্বাক্ষরের ছয় মাসের মধ্যে বিএসসির কাছে জাহাজ হস্তান্তর করতে হবে। আশা করছি আগামী বছরের শুরুর দিকে আমাদের বহরে দুইটি নতুন জাহাজ যুক্ত হবে।

সূত্র জানিয়েছে, গত ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিএসসির বোর্ড সভায় নিজেদের বহর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। রাষ্ট্রীয় একটি ফ্লিটে মাত্র পাঁচটি জাহাজ থাকা মেনে নেয়া যায় না বলেও অনেকেই মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে সর্বসম্মতভাবে দুটি জাহাজ কেনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বোর্ড সভায় জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কি ধরণের জাহাজ কেনা হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়। তিন ধরণের অপশন রাখা হয়।

প্রথমতঃ অর্ডার দিয়ে নতুন জাহাজ বানানো, দ্বিতীয়তঃ কোন ইয়ার্ডে নির্মাণাধীন থাকা জাহাজ পছন্দ করে কেনা এবং তৃতীয়তঃ পাঁচ বছরের কম পুরানো জাহাজ কেনা। তবে তিনটি অপশনের মধ্যে নির্মাণাধীন থাকা জাহাজ কেনার ব্যাপারে বোর্ডের সদস্যরা আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, তাহলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাহাজ বহরে যুক্ত করা সম্ভব হবে।

নতুন করে অর্ডার দিতে গেলে সময় বেশি লাগবে, আর পুরানো জাহাজে ঝুঁকি থাকে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী, ৫৫ হাজার থেকে ৬৬ হাজার টন ধারণক্ষমতার খোলা পণ্যবাহী জাহাজ কিনছে বিএসসি। উন্মুক্ত এই দরপত্রে বিএসসির তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাইরের যে কোন প্রতিষ্ঠানও অংশ নিতে পারবে। দরপত্র যাছাই বাছাই করে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে বিএসসি। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরুর চার মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ১০ জুন এমভি বাংলার দূত নামের একটি জাহাজ দিয়ে সংস্থার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়। বিভিন্ন সময় এই সংস্থার বহরে যুক্ত হয় ৪৪টি জাহাজ। এক সময় এই সংস্থার বহরে একইসাথে ২৫টি জাহাজ চলাচল করতো। কিন্তু নানামুখি অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় বিএসসি লোকসান দিতে দিতে একেবারে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়।

এক সময় এমন কথাও সংস্থায় প্রচলিত ছিল যে, জাহাজ বিক্রি করে সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতার যোগান দিতে হয়। বয়সের কারণে একের পর এক স্ক্র্যাপ হওয়া জাহাজ বিক্রি করতে করতে ২০১৮ সালে এসে সংস্থার বহরে জাহাজের সংখ্যা মাত্র দুইটিতে নেমে আসে। একপর্যায়ে ২০১৮ সালে দুটিতে নেমে আসে। এরপর চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বিএসসি’র বহরে ছয়টি জাহাজ কেনা হয়। ২০১৮ সালে তিনটি এবং ২০১৯ সালে তিনটি মিলে ওই ছয়টি জাহাজ নিয়ে বিএসসির বহর উন্নীত হয় ৮টি জাহাজে।

২০২২ সালের ২ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালে বিএসসির বহর আবার ৭টি জাহাজে নেমে আসে। গত বছরের অক্টোবরে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ৩৭ বছরের পুরনো এমটি বাংলার সৌরভ ও এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজ দুটি অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুইটি জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে পরবর্তীতে ৫৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়া হলে বিএসসিতে জাহাজের বহর নেমে আসে মাত্র ৫টিতে।

সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনার রাষ্ট্রায়াত্ত্ব একমাত্র সংস্থার বহরে মাত্র ৫টি জাহাজের ‘কষ্টকর’ অবস্থা থেকে বের হতেই এবার নিজস্ব অর্থায়নে দুইটি নতুন জাহাজ কেনা হচ্ছে বলে জানিয়ে সূত্র বলেছে যে, আগামী বছরের শুরুতে এই দুইটি জাহাজ বহরে যুক্ত হলে বিএসসিতে জাহাজের সংখ্যা ৭টিতে উন্নীত হবে।

কোম্পানিটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৪৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা নিট মুনাফা করেছে, যা গত ৫৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সময়ে কোম্পানির পক্ষে তার শেয়ারহোল্ডারদের ২৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসসির পরিচালনা বাবদ ৪৮৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে ১০৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আয় হয়েছে। এতে মোট আয় দাঁড়িয়েছে ৫৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকায়। অন্যদিকে পরিচালনা ব্যয় ছিল ১৮৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা এবং প্রশাসনিক ও আর্থিক খাতে ব্যয় হয় ১২১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এতে সর্বমোট ব্যয় দাঁড়ায় ৩১১ কোটি ৬০ টাকা।

চলতি বছরের ৩০ জুন বিএসসির পরিশোধিত মূলধন ছিল ১৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের শেয়ার ৭৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যা মোট শেয়ারের ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৭৩ কোটি ৭ লাখ টাকা, যা মোট শেয়ারের ৪৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসসির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮১১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যার বিপরীতে ঋণ আছে ২ হাজার ২৫৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

দ্বিতীয় প্রান্তিক চলতি হিসাব বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, ২০২৪ সময়ের দ্বিতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩ টাকা ৫২ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ৩ টাকা ২৯ পয়সা। দুই প্রান্তিকে বা ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২৪) কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ৯ টাকা ৩৫ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ইপিএস ছিল ৬ টাকা ৫৯ পয়সা। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ২০ টাকা ১০ পয়সা।

এদিকে চলতি হিসাববছরের তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৪ টাকা ৪৭ পয়সা। গত বছর একই সময়ে শেয়ার প্রতি ৪ টাকা ৮ পয়সা আয় হয়েছিল। অন্যদিকে তিন প্রান্তিক (জুলাই’২৩-মার্চ’২৪) মিলিয়ে কোম্পানিটির ১১ টাকা ৫ পয়সা আয় হয়েছে। গতবছর একই সময়ে ১২ টাকা ৪৯ পয়সা আয় হয়েছিল। আলোচিত সময়ের কোম্পানির শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ ছিল ২৩ টাকা ৫৯ পয়সা, যা আগের বছর ১৯ টাকা ৪৮ পয়সা ছিল। গত ৩১ মার্চ ২০২৪ তারিখে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ৯৫ টাকা ২৫ পয়সা।

এই সময়ে শেয়ারপ্রতি আয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বিএসসি ও মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপের কারণে শেয়ারপ্রতি আয় বেড়েছে। এর মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল বৃদ্ধিতে নেওয়া বিশেষ উদ্যোগ। সমুদ্রবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল থেকে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি।
গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বিএসসির পরিশোধিত মূলধন ছিল ১৫২ কোটি ৫৩ কোটি টাকা।

এর মধ্যে সরকারের শেয়ার ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য ৭৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া বেসরকারি শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারের অংশ ৪৭ দশমিক ৯০ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য ৭৩ কোটি ৭ লাখ টাকা। গত এক বছরে বিএসসির শেয়ারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১৩১ টাকা ৫০ পয়সা এবং সর্বনিম্ন দাম ছিল ৫৩ টাকা ১০ পয়সা। এ ছাড়া কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ২৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ২৫ শতাংশ, ২০২২ সালে ২০ শতাংশ ও ২০২১ সালে ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

বিএসসির এমডি কমোডর মাহমুদুল মালেক বলেন, আমরা এবারও বেশ ভালো মুনাফা করবো। গতবছরও মুনাফা করেছি। মুনাফার এই ধারা অব্যাহত রেখে আমরা আমাদের বহরকে আরো সমৃদ্ধ করবো ইনশাআল্লাহ।