আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবসিডিয়ারির বিনিয়োগ কমেছে ২৬৬ কোটি টাকা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। আয় কম করে কোনো খাতে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রদর্শন আবার আয় বেশি করেও কম দেখিয়ে বিনিয়োগকারীদের সাথে প্রতারণা করার অভিযোগ রয়েছে। এরকম প্রতারণার পাশাপাশি নানা অনিয়ম দুর্নীতির উপসর্গ রয়েছে ব্যাংকটিতে। যেমন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানতের ওপর জোর না দিয়ে ক্রমেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ বেড়েছে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের।
এতে বেড়েছে তহবিল খরচ, গুনতে হচ্ছে ভর্তুকি। ব্যাংকটির কিছু আমানত আটকে আছে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। এ আমানত সেখান থেকে ফিরে আসবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ অনেকের। ক্রমবর্ধমান কুঋণ উদ্ধারের কোনো পরিকল্পনা নেই ব্যাংকটির। এছাড়া আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ২০২৪ সালে ৩৯১ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই লোকসানের পরিবর্তে কৃত্রিমভাবে মুনাফা দেখিয়েছে। যা নিরীক্ষকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
নিরীক্ষক জানিয়েছেন, কোম্পানিটির ২০২৪ সালের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) প্রদত্ত ঋণ ও কন্টিনজেন্ট দায়ের বিপরীতে প্রভিশন বা সঞ্চিতি রাখা হয়েছিল ৫৬৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা। তবে পুরো বছরে বা ১২ মাসের বার্ষিক আর্থিক হিসাবে ওই সঞ্চিতির পরিমাণ কমিয়ে ৩৭৩ কোটি ৪১ লাখ টাকায় নামিয়ে এনেছে। অর্থাৎ সঞ্চিতির পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে ১৯৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ফলে ওই সঞ্চিতি কমানোর কারনে মুনাফায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কোম্পানিটির প্রদত্ত ঋণের টাকা আদায়ে কোন উন্নতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ২৯ এপ্রিলের নির্দেশনা অনুযায়ি আল-আরাফাহ ব্যাংকে প্রদত্ত ঋণ, অফ ব্যালেন্স শীট ও অন্যান্য কারনে সঞ্চিতির পরিমাণ ৬৩৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা দরকার ছিল বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক। কিন্তু ব্যাংক ওইসব কারনে সঞ্চিতি করেছে ২৩৭ কোটি ১১ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ৩৯৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
নিরীক্ষক জানিয়েছেন, ব্যাংকটির ব্যাবসায়িক মন্দার কারনে লভ্যাংশ দিতে পারবে না বলে গত ২১ মে এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ব্যাংকটির আর্থিক হিসাবে ৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা মুনাফা দেখানো হয়েছে। তবে ব্যাংকটি সম্পূর্ণ সঞ্চিতি গঠন করলে, মুনাফার পরিবর্তে লোকসান হতো ৩৯১ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
অন্যদিকে লোকসানকে মুনাফা দেখানো আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি এআইবি ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেসের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। কোম্পানিটির এরইমধ্যে বিনিয়োগের ২৬৬ কোটি টাকা নাই হয়ে গেছে। ব্যাংকটির ২০২৪ সালের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষায় এই তথ্য জানিয়েছেন নিরীক্ষক।
নিরীক্ষক জানিয়েছেন, ব্যাংকটির সাবসিডিয়ারি এআইবি ক্যাপিটাল মার্কেট সার্ভিসেস এর বিনিয়োগের বাজার দর কমে গেছে ২৬৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সঞ্চিতি গঠন করা হয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে সঞ্চিতির ঘাটতি ২১৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এই ব্যাংকটির ক্যাপিটাল টু রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) দাড়িয়েছে ১২.১৩ শতাংশে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ি থাকার দরকার ১২.৫০ শতাংশ। এক্ষেত্রে ঘাটতি ০.৩৭ শতাংশ বলে জানিয়েছে নিরীক্ষক।
এদিকে ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ২৪ ধারা অনুযায়ি, সংবিধিবদ্ধ রিজার্ভ পরিশোধিত মূলধনের সমান না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের করপূর্ব মুনাফার ২০ শতাংশ ওই রিজার্ভে স্থানান্তর করতে হয়। কিন্তু আল-আরাফাহ ব্যাংকে এমনটি করা হয়নি।
অথচ ব্যাংকটিতে ২৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা স্থানান্তর করা দরকার ছিল বলে জানিয়েছে নিরীক্ষক। এই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একক ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানে সর্বোচ্চ সীমা ৬১২ কোটি টাকা (মূলধনের ১৫ শতাংশ ৪,০৭৬.৬৭ কোটি টাকা) অতিক্রম করেছে। এছাড়া একাধিক ক্লায়েন্টের জন্য মূলধনের ২৫ শতাংশ বা ১,০১৯ কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করেছে।
নিরীক্ষক জানিয়েছেন, বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানিতে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আল-আরাফাহ ব্যাংকে এই শেয়ার ধারনের হার মাত্র ১৫.১১ শতাংশ। ১৯৯৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।