শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারের এসএমই প্লাটফর্মে তালিকাভুক্ত কোম্পানি কৃষিবিদ ফিডের উদ্যোক্তা জিন্নাত আরা সম্প্রতি আইন বহির্ভূতভাবে দেড় লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। পরবর্তীতে বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হলে, তিনি দুঃখ প্রকাশ করে শেয়ার বিক্রির ঘোষণা প্রত্যাহার করে নেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সম্প্রতি ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে।

বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, কৃষিবিদ ফিডের উদ্যোক্তা জিন্নাত আরা শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ নভেম্বর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবরটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। তাই এই বিষয়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স, ১৯৬৯ এর ধারা ৬(৩) এর অধীনে ডিএসইকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন অনুযায়ী, কোনও কোম্পানির বার্ষিক হিসাব সমাপ্ত হওয়ার দুই মাস পূর্ব থেকে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক উক্ত হিসাব বিবেচিত, গৃহীত বা অনুমোদিত হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত কোনও পরিচালক, স্পন্সর কেউ শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না। যেহেতু কৃষিবিদ ফিড জুন ক্লোজিং বা হিসাব বছর সমাপ্ত হয় জুন মাসে (জুলাই-জুন)। গত জুন মাসে কোম্পানিটির হিসাব বছর সমাপ্ত হলেও আলোচিত সময়ে পর্ষদ সভায় সর্বশেষ হিসাব বছর অনুমোদিত হয়নি। ফলে এই সময়ে কোনও উদ্যোক্তা শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেওয়া আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

তথ্য মতে, চলতি বছরের গত ১০ নভেম্বর কৃষিবিদ ফিডের উদ্যোক্তা জিন্নাত দেড় লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। তার ওই ঘোষণার মাধ্যমে কৃষিবিদ ফিড আইন লঙ্ঘন করে। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হলে শেয়ার বিক্রির ঘোষণা প্রত্যাহার করে কোম্পানি।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর উভয় স্টক এক্সচেঞ্জের এসএমই প্লাটফর্মে লেনদেন শুরু করে কৃষিবিদ ফিড।৪৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৪ কোটি ৯৫ লাখ। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৩৪.৬১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৪.৪৪ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে ২০.৯৫ শতাংশ শেয়ার আছে।

অভিযোগ রয়েছে, ঋণে জর্জরিত কৃষিবিদ ফিড লিমিটেড পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তুলতে ‘অতিরঞ্জিত’ সম্পদ দেখিয়েছে। কোম্পানিটি কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২২ কোটি টাকা উত্তোলন করে।

কোম্পানিটির বেশকিছু সম্পদ মূল্য নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো হলো- অর্থ উত্তোলনের জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) কৃষিবিদ ফিডের প্রসপেক্টাসের ১২২ নম্বর পেজের ৬ নম্বর নোটে ইনভেন্টরিজ দেখানো হয়েছে ২৮ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩২ টাকা। একই পেজে ৭ নম্বর নোটে ট্রেড অ্যান্ড আদার রিসিভেবল দেখানো হয়েছে ৩৬ কোটি ৭৫ লাখ ৬২ হাজার ৯০৭ টাকা।

সবচেয়ে বড় সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে জমি ও ফ্ল্যাট বাবদ দেওয়া অগ্রিম অর্থ নিয়ে। একই পেজের ৮ নম্বর নোটে এডভান্স এগেইস্ট ল্যান্ড অ্যান্ড ফ্ল্যাট পারচেজ দেখানো হয়েছে ৪৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৯ টাকা

যেসব জমি ও ফ্ল্যাট ঢাকার সাভারে ও ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএসইসি সরেজমিনে জমি ও ফ্ল্যাটের বাজার মূল্য ও কোম্পানিটির প্রসপেক্টাসে দেওয়া মূল্য যাচাই করলে বিষয়টি পরিস্কার ধরা পড়বে।

এদিকে বড় ধরনের ঋণে জর্জরিত কোম্পানিটি। কৃষিবিদ ফিডের ১৪৩ নম্বর পেজের ১৩ নম্বর নোটে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ উল্লেখ করা হয়েছে ২৪ কোটি ২৬ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৬ টাকা ও ১৫ নম্বর নোটে স্বল্পমেয়াদী ঋণ ৮৩ কোটি ৮২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৬ টাকা। অর্থাৎ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী মিলে ১০৮ কোটি টাকার উপরে কোম্পানিটির ঋণ রয়েছে। প্রসপেক্টাস সূত্রে জানা যায় এই ঋণের সুদ দেওয়ার মতো অবস্থাও নেই কোম্পানিটির।

কৃষিবিদ ফিডের প্রসপেক্টাসের ১৪৫ নম্বর পেজের ১৫.০২ নম্বর নোটে স্বল্পমেয়াদী ঋণের জন্য সুদ বকেয়া রয়েছে ১৩ কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজার ৫৩১ টাকা। আর ১৭.০৩ নম্বর নোটে দীর্ঘমেয়াদী ঋণে সুদবাবদ বকেয়া ৩ কোটি ৫ লাখ ১ হাজার ১৫৩ টাকা।

যে কোম্পানিটির ঋণের সুদের অর্থ দেওয়ার মতই সক্ষমতা নেই সেই কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেবে কীভাবে এই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। একই সঙ্গে এত ঋণ থাকা সত্বেও কীভাবে কোম্পানিটি এত সম্পদে বিনিয়োগ করেছে। এখানেই পরিস্কার কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্যই সম্পদ বেশি দেখিয়েছে।

এদিকে নিরীক্ষায় নিয়োজিত অডিট ফার্মের তালিকা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অযোগ্য’ বিবেচিত হয়ে বাদ পরা আশরাফ উদ্দিন অ্যান্ড কোং-এর মাধ্যমে নিরীক্ষা করে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তোলার প্রক্রিয়ায় রয়েছে কৃষিবিদ ফিড। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকা বহির্ভূত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষায় নিয়োজিত ৩৬টি ফার্মকে ‘অযোগ্য’ বিবেচনা করে বাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই তালিকায় রয়েছে আশরাফ উদ্দিন অ্যান্ড কোং। নানা অনিয়ম করে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অযোগ্য অডিট ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষা করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ তোলা নিয়ে কৃষিবিদ ফিডের আর্থিক হিসাব নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কৃষিবিদ ফিড লিমিটেড কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ২২ কোটি টাকা উত্তোলন করে। উত্তোলিত অর্থ ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, কারখানা ভবন নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ক্রয়, ডিজেল জেনারেটর ক্রয়, ডেলিভারি ভ্যান ক্রয় এবং ইস্যু ব্যবস্থাপনা খরচ খাতে ব্যয় করার কথা কৃষিবিদ ফিডের।

এসএমই প্লাটফর্মে লেনদেনের তারিখ থেকে পরবর্তী তিন বছর ইস্যুয়ার কোম্পানি কোনো বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে পারবে না। কোম্পানিটির ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এমটিবি ক্যাপিটাল।