শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানি ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এক সময়ে ভালো সুনাম ছিল। কোম্পানিটি বছর শেষে ভালো মুনাফা করত এবং শেয়ারহোল্ডারদের ভালো লভ্যাংশও দিত। অন্যদিকে পলিসি হোল্ডারদের দাবিও সময়মতো মেটাতো। কিন্তু সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক উদ্যোক্তা পরিচালক এম এ খালেকের লুটপাটে কোম্পানিটি এখন ডুবে গেছে।

যেখানে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডাদের ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে, সেখানে ২০১৯ সালে কোনো রকমে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিলেও গত দু বছর ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশই দিতে পারছে না। অন্যদিকে, এর আগে কোম্পানি পলিসি হোল্ডারদের বিমা দাবি মেটানোয় সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারলেও এখন নেই। পলিসি হোল্ডারদের বিমা দাবি মেটাতে ও পরিচালন ব্যয় মেটাতে চলতি বছর রাজশাহী, বগুড়া, মুন্সীগঞ্জ ও রংপুরে প্রায় ৩১ কোটি টাকার জমি বিক্রি করেছে। তারপরও কোম্পানিটি অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক পরিচালক এম এ খালেক বিভিন্ন উপায়ে কোম্পানি থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট করা এ অর্থ আদায়ের জন্য কোম্পানির করা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামলার শুনানি শেষে ফারইস্ট লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে দুদিনের রিমান্ড দেন। এ ছাড়া বিমা কোম্পানিটির সাবেক পরিচালক এম এ খালেক ও তার ছেলে রুবায়াত খালেককে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন আদালত।

যেভাবে লুটপাট শুরু: কোম্পানির সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা আলোচ্য সূচি ও সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক্সট্রাক্ট বা প্রতিলিপি তৈরি ও ইস্যু করেন সাবেক পরিচালক এম এ খালেক এবং সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। এর মাধ্যমে কোম্পানির বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা এমটিডিআর/আমানত তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের বিপরীতে জামানত দিয়ে এবং ওই জামানত বাবদ কোম্পানির মোট এমটিডিআর ৮১৬ কোটি টাকা ব্যাংক কর্তৃক সমন্বয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। ওই এমটিডিআর হালনাগাদ মুনাফাসহ ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।

কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক পরিচালক তাদের নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে কম দামে জমি কিনে সেই জমি কোম্পানির কাছে বেশি দামে বিক্রি করে প্রায় ৬৬৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে ২৮৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা। এ ছাড়া কোম্পানির বিভিন্ন ক্রয় লেনদেনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।

লুটপাটের খবর প্রকাশ ও আইনগত কার্যক্রম: নজরুল ও খালেকের এসব অনিয়মের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর নজরুল ইসলাম এবং এম এ খালেকের নিয়ন্ত্রণাধীন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে স্বাধীন পরিচালকের সমন্বয়ে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয়।

তাদের অনিয়ম তদন্ত করে ঘটনা উদ্ঘাটনের জন্য বিএসইসি এবং বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) একাধিক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব নিরীক্ষার মাধ্যমে এখনো পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের বিষয় উদঘাটিত হয়েছে, যার সঙ্গে সরাসরি তারা জড়িত ছিলেন।

লুটপাটে আরও যারা জড়িত: এসব অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাৎ প্রক্রিয়ায় কোম্পানির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্যাহ ও শেখ আব্দুর রাজ্জাকসহ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং এ অনিয়ম প্রক্রিয়ায় সহযোগী ছিলেন বলে মামলায় তাদেরও অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত অন্যরা হলেন: শাহরিয়ার খালেদ, রুবাইয়াত খালেদ, মো. তানভিরুল হক, নুর মোহাম্মদ ডিকন। তারা ফারইস্ট লাইফের পরিচালক থাকা অবস্থায় অর্থ আত্মসাৎ করতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং নিজেরাও আত্মসাৎ করেছেন।

সাবেক পরিচালক খালেক ও চেয়ারম্যান নজরুলকে অর্থ আত্মসাতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠাদের তালিকায় নাম এসেছে, সাবেক সিইও আলী হোসেন, একরামুল আমিন, সিএফও ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আলমগীর কবির, এএমডি অ্যান্ড ইনচার্জ অর্থ ও হিসাব (একক বিমা) কামরুল হাসান খান, ইভিপি অ্যান্ড ইনচার্জ ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট শেখ আব্দুর রাজ্জাক, জেইভিপি হেড অব ইন্টারনাল অডিট অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ডিপার্টমেন্ট মো. কামাল হোসেন হাওলাদার, ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্টের এফএভিপি মোহাম্মদ মাকবুল এলাহির।

জমি কেনায় যেভাবে অর্থ আত্মসাৎ: ফারইস্ট লাইফ ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে একাধিক জমি কিনেছে। এসব জমি কেনা হয়েছে বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এর মধ্যে সাতটি জমি কেনা ও ভবন নির্মাণ এবং বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

কোম্পানিটির হিসাবে দেখানো হয়েছে, মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির ৭৮৬ শতাংশ জমি ১৯৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে। বাস্তবে এ জমি কেনা হয়েছে ১৯ কোটি টাকায়। ১৯৯ কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে চেকে দেওয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা অ্যাসোসিয়েটকে চেকে দেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ চেকে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দেওয়া হয়েছে নগদে।

রাজধানীর ৭২ কাকরাইলের জমি কেনায় ১৬০ কোটি এবং গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউয়ের জমি কেনায় ৮৯ কোটি, গুলশানের আরও দুই জমিতে ৮০ কোটি এবং বরিশালের আলেকান্দায় একটি জমি কেনায় ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে কাকরাইলের জমি কেনা হয়েছে। জমি বিক্রির পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাছলিমা ইসলামকে ১১৫ কোটি টাকা উপহার দেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। তাছলিমা ইসলাম আবার সেখান থেকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন তার স্বামী নজরুল ইসলামকে।

নজরুল ইসলামের বন্ধু নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুই সহোদর মো. সোহেল খান ও মো. আজাহার খানের কাছ থেকে তোপখানা রোডের জমি কেনা হয়েছে। আর মিরপুর চটবাড়ীর নিচু এলাকার জমি কেনা হয়েছে ২০ জন বিক্রেতার কাছ থেকে। এসব দলিলে বলা হয়েছে, জমির মালিকদের টাকা দেওয়া হয়েছে নগদে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বিমা আইন অনুযায়ী, ৫ হাজার টাকার বেশি হলেই লেনদেন করতে হয় ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে।

এফডিআর বন্ধক রেখে যেভাবে ঋণ: কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমটিডিআর বন্ধক রেখে ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ফারইস্ট লাইফের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের একাংশ। এর মধ্যে এম এ খালেক, প্রাইম প্রোপার্টি, প্রাইম ফাইন্যান্স, ম্যাকসন্স, মিজানুর রহমানের নামে বন্ধক রেখে ৫৪২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

ফারইস্টের এমটিডিআর বন্ধক রেখে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নামে ১৬৪ কোটি, পিএফআই প্রোপার্টিজের নামে ১৬০ কোটি, ফারইস্ট প্রোপার্টিজের নামে ১৫১ কোটি, প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ৯২ কোটি, মিথিলা প্রোপার্টিজের নামে ৬৪ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ৫৫ কোটি, মিথিলা টেক্সটাইলের নামে ৪৮ কোটি, কে এম খালেদের নামে ২১ কোটি, মোল্লা এন্টারপ্রাইজের নামে ২০ কোটি, আজাদ অটোমোবাইলসের নামে ৯ কোটি এবং কামাল উদ্দিনের নামে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

ক্ষতিকর যেসব বিনিয়োগ ও অনিয়ম: নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর বিনিয়োগের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ২৮৭ কোটি টাকার তহবিল আত্মসাৎ করেন কোম্পানিটির সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।

এর মধ্যে বাংলালায়ন কনভার্টেবল জিরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪০ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৩২ কোটি, প্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪ কোটি, আল-ফারুক ব্যাগসে বিনিয়োগের মাধ্যমে ২ কোটি এবং কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব দেখিয়ে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া তিন বছরে ৪৩২ কোটি টাকার পরিচালনাগত ত্রুটি ও অনিয়ম হয়।