শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত কারসাজির হোতা আবুল খায়ের হিরোর শেয়ার কারসাজির বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে গত এক বছরে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ অন্তত ২০টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এর বাইরে পাঠিয়েছে শতাধিক নিয়মিত সার্ভেল্যান্স প্রতিবেদন। একের পর এক তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরও হিরোর কারসাজি বন্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

তবে এবার লোক দেখানো ফরচুন সুজ ও এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজিতে আবুল খায়ের হিরু ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এই কারসাজিতে আবুল খায়ের হিরু, তার বাবা আবুল কালাম মাতবর, স্ত্রী কাহী সাদিয়া হাসান, বোন কনিকা আফরোজ, শ্যালক কাজী ফরিদ হাসান ও তার কোম্পানি ডিআইটি কো-অপারেটিভ জড়িত। তারা ফরচুন সুজ কারসাজিতে রিয়েলাইজড ৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং আনরিয়েলাইজড ২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা মুনাফা করেছে বলে ডিএসইর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজিতে রিয়েলাইজড ১৫ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং আনরিয়েলাইজড ২৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছে বলে ডিএসইর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। ডিএসই হিরু ও তার পরিবারের সম্পৃক্ততায় ওই কোম্পানি দুটির শেয়ার কারসাজিতে ৯৪.৬৭ শতাংশ দর বৃদ্ধি দেখতে পায়। যা ২০২১ সালের ২০ মে থেকে ১৭ জুন এক তদন্তে পাওয়া যায়। এর আগে হিরু ও তার সহযোগিদেরকে গ্রীন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স ও এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের কারসাজিতে ২ কোটি ৯ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।

তবে আবুল খায়ের হিরোর বিরুদ্ধে একের পর এক তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরও কারসাজি বন্ধে অদৃশ্য কারণে ব্যবস্থা নেয়নি বলে লোক মুখে শোনা যাচ্ছে। যদিও ডিএসই যে সফটওয়্যার দিয়ে শেয়ার লেনদেন তদারকি করে, তার চেয়েও উন্নত সফটওয়্যার বিএসইসির কাছেই আছে। সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিশেষ আমলা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

তবে শেয়ারবাজারের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিনিয়োগকারী মো. আবুল খায়ের ওরফে হিরুকে কারসাজি করে শেয়ার দর বাড়ানোর অভিযোগে ২ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। সম্প্রতি এক কমিশন সভায় হিরুকে ‘কথিত’ জরিমানা করা হয়েছে বলে জানায় বিএসইসি। ২০টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হলেও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

ডিএসইর কর্মকর্তারা জানান, শেয়ার কারসাজির ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং তদন্ত করে বিএসইসির কাছে প্রতিবেদন পাঠানোর বাইরে আর কিছু করার আইনি ক্ষমতা স্টক এক্সচেঞ্জের নেই। তদন্ত প্রতিবেদন বা সার্ভেল্যান্স পর্যবেক্ষণ আমলে নেবে কিনা, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখতিয়ার। ২০২১ সালের ৩১ মে পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনে ডিএসই জানায়, কীভাবে হিরো ও তাঁর স্ত্রীর কারসাজিতে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ওই বছরের ৪ এপ্রিল থেকে ৩ মে, অর্থাৎ এক মাসেই ৩৮ থেকে ৮৬ টাকা ছাড়িয়েছিল। এ কারসাজিতে হিরো ও তাঁর স্ত্রী সোয়া ৫ কোটি টাকা মুনাফা করেন।

একই বছরের ৩ জুন পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনে হিরো, তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের ডিআইটি কো-অপারেটিভের নামে শেয়ার কেনাবেচায় কীভাবে ওই বছরের ৫ এপ্রিলে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর ৫০ টাকা থেকে দুই মাস পর ২ জুনে ১০২ টাকায় তুলে দেড় কোটি টাকা মুনাফা করেন, সেই কারসাজির চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। যদিও এর কয়েক দিনের মধ্যেই শেয়ারটির দর দেড়শ টাকা ছাড়ায় তাদেরই কারসাজিতে এবং আরও প্রায় সমান অঙ্কের মুনাফা হয়। তা নিয়ে আর তদন্ত করেনি ডিএসই।

এ ছাড়া ডেল্টা লাইফের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ অক্টোবর, অর্থাৎ দেড় মাসের শেয়ার কারসাজির তদন্ত প্রতিবেদনটি স্টক এক্সচেঞ্জ পাঠিয়েছিল গত জানুয়ারিতে। প্রতিবেদনে হিরো, তাঁর স্ত্রী, বাবা, ভাই, বোন, ব্যবসায়িক পার্টনার এবং তাঁর শেয়ার কারসাজি সিন্ডিকেটের একটা অংশ কীভাবে কারসাজি করে এ শেয়ারটির দর ১৪৫ থেকে ২২৬ টাকায় তুলেছিল, সেটার বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয় ডিএসই। শুধু ওই দেড় মাসের কারসাজিতে হিরো সিন্ডিকেটের সাড়ে ৫১ কোটি টাকা মুনাফা (রিয়েলাইজড) তুলে নেয়।

অবিক্রীত শেয়ারে তখনও মুনাফা ছিল প্রায় ১৮ কোটি টাকা। কী করে হিরো তাঁর স্ত্রী ও নামসর্বস্ব সমবায় সমিতি ডিআইটি কো-অপারেটিভকে ব্যবহার করে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের ৩০ টাকা দরের এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের দর দেড় মাস পর ৬৮ টাকায় তুলেছিলেন এবং শুধু এ সময়ে সোয়া তিন কোটি টাকা রিয়েলাইজড মুনাফা ছাড়াও সোয়া ৫ কোটি টাকার আনরিয়েলাইজড মুনাফা করেন, তাও সবিস্তারে তুলে ধরে ডিএসই। শেয়ারটির দর তাঁদের কারসাজিতেই গত ১৯ জানুয়ারি ১২৯ টাকায় ওঠে, যার মাধ্যমে অন্তত ১৫ কোটি টাকা রিয়েলাইজড মুনাফা হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে।

এনআরবিসি ব্যাংক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় গত বছরের ২২ মার্চ। এর এক মাসের মধ্যে ওই শেয়ার নিয়ে কারসাজি শুরু করেন হিরো। এ ব্যাপারে গত আগস্ট ও ফেব্রুয়ারিতে বিএসইসিতে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় ডিএসই। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৭ মের মধ্যে এক মাসেই ব্যাংকটির দর ১১ থেকে ৪০ টাকায় তোলে হিরো সিন্ডিকেট।

এরপর ২০২১ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে প্রভাতী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির বিষয়ে ওই বছরের জুলাই এবং একই বছরের এপ্রিল থেকে জুনে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের দর ৬০ থেকে ২০০ টাকায় ওঠানোর ক্ষেত্রে হিরোসহ অন্যদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে গত সেপ্টেম্বরে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় ডিএসই।

একইভাবে ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের এবং সেপ্টেম্বরে মালেক স্পিনিং ও জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার কারসাজির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন বিএসইসির কাছে পাঠায়। এ ছাড়া ফরচুন শুজের শেয়ার কারসাজির বিষয়ে তিনটি আলাদা তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। এ ছাড়া গত জানুয়ারিতে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির বিষয়ে প্রায় একই সময়ে হামিদ ফেব্রিক্স এবং ফেব্রুয়ারিতে সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় ডিএসই।

এসব তদন্ত প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে হিরো কীভাবে তাঁর স্ত্রী, বাবা, বোন, ভাই, নিজের স্বার্থ-সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে একের পর এক কোম্পানির শেয়ারদর কারসাজি করে শত শত কোটি টাকা মুনাফা করেছেন, তার বিস্তারিত তুলে ধরে। তার পরও বিএসইসির শীর্ষ কর্মকর্তা হিরোর কারসাজির বিষয়ে গণমাধ্যমে বলেছেন, হিরোর কারসাজির বিষয়ে কোনো তথ্য এ সংস্থার কাছে নেই।