শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের কোম্পানি ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ারে শতকোটি টাকার বেশি বাড়তি বিনিয়োগ ধরে রাখতে এবার ব্যাংক খাতের কোম্পানি সাউথইস্ট ব্যাংক চাতুরী ও আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। এবার নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা করিয়ে দেওয়ার শর্তে পুঁজিবাজার সংশ্নিষ্ট একটি পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রথমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য গঠন করা স্পেশাল ফান্ড অ্যাকাউন্ট থেকে ন্যাশনাল লাইফের ২১ লাখ শেয়ার ৪৩ কোটি টাকায় বিক্রি করেছে।

বিক্রির এক সপ্তাহের মধ্যে ওই শেয়ারই প্রতিটি ১৫ টাকা বেশি দরে একই অ্যাকাউন্ট দিয়ে কিনে নিয়েছে। বীমা কোম্পানিটিতে আইনি সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিলে গত বছরও প্রায় একই ঘটনা ঘটায় সাউথইস্ট। এ জন্য বড় অঙ্কের জরিমানাও গুনতে হয়েছিল ব্যাংকটিকে।

পুঁজিবাজারে দরপতন ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবে ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোকে পাঁচ বছর মেয়াদে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বিনিয়োগ অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ফান্ডের বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সীমার বাইরে রাখারও সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুযোগই নিয়েছে সাউথইস্ট।

একটি দৈনিক পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে সমঝোতার কেনাবেচা হয়। এতে ব্যাংকটির অন্তত তিন কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ব্যাংকটি ডিএসইর একটি ব্রোকারেজ হাউসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে প্রথমে কম মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে এক সপ্তাহের মধ্যে বেশি দরে কেনার সমঝোতা করে। সমঝোতার অংশ হিসেবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি গড়ে ২০৫ টাকা দরে ২০ লাখ শেয়ার বিক্রি করে।

ক্রেতা ছিলেন- মমিনুর রহমান, নাভা ফার্মা, ইসলাম ব্রাদার্স, নাভিল নাভা ফুডস, নাভিল ফিস মিলস, রেজাউল করিম, রীদিশা টেক্সটাইল, রীদিশা নিটেক্স, মাসুদ আলম ও ফারিহা মেহজাবিন।

সমঝোতা অনুযায়ী, গত ২০ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি গড়ে ২২০ টাকা দরে শেয়ার কিনে নেয় সাউথইস্ট। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতা ছিলেন ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উদ্যোক্তাদের সংশ্নিষ্ট শাহিদা আলম এবং একেএম বদিউল আলম। তারা সবাই ওই ব্রোকারেজ হাউসের গ্রাহক। ব্রোকারেজ হাউসটির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা এ তথ্য স্বীকারও করেছেন। এক প্রশ্নের মুখে তিনি বলেন, কোটি কোটি টাকার ‘ডিল’ আগাম সমঝোতা ছাড়া সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে সাউথইস্টের এমডি এম কামাল হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ মোতাবেক অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি হয়েছে বলে শুনেছি। কিন্তু এ কেনাবেচায় কোনো সমঝোতা বা লোকসান হয়েছে কিনা জানি না। ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট কমিটির প্রধান হয়ে না জানার সুযোগ আছে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সবই তো জানেন। নতুন করে কিছু বলতে চাই না। চাকরির মেয়াদ আর সাত মাস আছে। ঝামেলা ছাড়া শেষ করতে চাই।’

ব্যাংকের সিএফও রাশেদুল ইসলাম স্বীকার করেন, প্রথমে কম দামে শেয়ার বিক্রি করে একই অ্যাকাউন্টে একটু বেশি দরে শেয়ার কেনা হয়েছে। এতে আইনের ব্যত্যয় হয়নি। কী করে একই ব্রোকারেজ হাউসের গ্রাহকরা সব শেয়ার কিনলেন এবং বিক্রি করলেন- এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটা কাকতালীয় হতে পারে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক নিজের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশ বা নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধনের ৫ শতাংশের বেশি মূল্যের বা নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারে না। সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বাজারমূল্যে একক কোনো কোম্পানির সর্বোচ্চ ১১৯ কোটি টাকার বেশি শেয়ার ধারণ করার সুযোগ নেই।

কিন্তু গত বছরের শুরুতে শুধু নিজস্ব পোর্টফোলিও অ্যাকাউন্টেই ন্যাশনাল লাইফের এক কোটি সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি শেয়ার ধারণ করে, যার বাজারমূল্য ছিল আড়াইশ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরেও দেড়শ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ ছিল মার্চেন্ট ব্যাংকসহ ব্যাংকের ফাউন্ডেশন ও গ্রিনফান্ড নামের অন্য অ্যাকাউন্টে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে বিনিয়োগ করায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের মার্চে সাউথইস্টকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পেয়ে ব্যাংকটি জানায়, দেশের শেয়ারবাজারে নির্দিষ্ট দিনে ন্যাশনাল লাইফের তিন থেকে চার হাজারের বেশি শেয়ার কেনাবেচা হয় না। এ অবস্থায় বিপুল অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করতে অন্তত ছয় মাস সময় দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংক আবেদন মঞ্জুর করে। এর প্রায় সাত মাস পর ব্যাংকটি চিঠি দিয়ে জানায়, এক কোটি ছয় লাখ শেয়ারের মধ্যে ২৩ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছে। বাকি অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহারে আরও ছয় মাস সময় প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংক পরীক্ষা করে দেখতে পায়, ব্যাংকটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে নিজস্ব পোর্টফোলিও অ্যাকাউন্ট থেকে বিক্রি করে স্পেশাল ফান্ড অ্যাকাউন্টে কিনেছে। অর্থাৎ এ লেনদেনে ব্যাংকটি নিজেই ক্রেতা ও বিক্রেতা ছিল। এভাবে শেয়ার কেনাবেচা করা শেয়ারবাজার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেনটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে সিদ্ধান্ত দেয়। একই সঙ্গে ওই লেনদেনকে ‘চাতুরীপূর্ণ’ মন্তব্য করে প্রতারণামূলক তথ্য দেওয়ার অপরাধে সাউথইস্টকে এককালীন ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পাশাপাশি যতদিন প্রকৃত অর্থে শেয়ারগুলো বিক্রি না হবে, ততদিন প্রতিদিনের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে। পরের দুই মাসেও আগের লেনদেনটি সংশোধন না করায় গত ডিসেম্বরে পুনরায় সাউথইস্টকে সাড়ে ২১ লাখ টাকা জরিমানা করে।

এত কিছুর পরও ব্যাংকটি ন্যাশনাল লাইফের অতিরিক্ত বিনিয়োগ প্রত্যাহার না করায় গত জানুয়ারিতে এসে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খবর জেনে বিকল্প উপায়ে শেয়ার ধরে রাখার ফন্দি করে সাউথইস্ট এবং সর্বশেষ সমঝোতামূলক কেনাবেচা তারই অংশ।