শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৯৯৫ সালে ৫০০ কোটি টাকা অনুমোদন নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বাজারে লেনদেনে থাকা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযোগ। বাজারে আসার পর থেকে একের পর এক দুর্নীতি, অনিয়ম, ডিভিডেন্ড না দেওয়া, এজিএম না করা, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়াসহ কোম্পানিটির সঙ্গে জুড়েছে নানান অপকর্ম। এত অভিযোগ আর অব্যবস্থাপনার পরও কোম্পানির শেয়ারদরে মাঝে মধ্যেই উল্লম্ফন দেখা যায়।

কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৮ সালে এজিএম করে। এরপর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আর কোনো এজিএম হয়নি তাদের। আবার ২০১৮ সালের পর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়ারও নাম নেই কোম্পানিটির।

একের পর এক অনিয়মের মধ্যে কোম্পানি থেকে প্রকাশ করেনি কোনো আর্থিক বিবরণী। রাজস্ব বোর্ডকে ফাঁকি দিয়েছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। কোম্পানিটির সর্ব সাকুল্যে অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১১ কোটি ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার ২৬২ টাকা ও সুদ বাবদ ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ১০ হাজার ৭৯৯ টাকাসহ সর্বমোট ২৫ কোটি ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৬১ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির ১০টি অনিয়মকে অধিকতর মনে করে তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছিলো। এ ছাড়াও এসব অনিয়ম ও ব্যর্থতার কারণে প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আদিবা রহমানের পুনঃনিয়োগের আবেদন বাতিল করেছিলো বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা- আইডিআরএ।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী প্রকাশ ছাড়াই ২০১৯ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর এজিএম করে ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। উল্লেখিত অর্থবছরে কোনও লভ্যাংশও দেয়নি কোম্পানিটি। ওয়েবসাইট থাকলেও ২০১৯ সালের ৩য় প্রান্তিক প্রকাশের পর আর কোন আর্থিক বিবরনী প্রকাশিত হয়নি কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে।

এদিকে ৩ বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনও প্রকার লভ্যাংশ দেয়নি ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৮ সালে ২৬ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর কোম্পানির প্রায় ২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছিলো মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা)। ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলা করা হয়েছে বলে জানান ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।

সেসময় ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক বলেছিলেন, ডেল্টা লাইফের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় ভ্যাট গোয়েন্দা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত করে। তাদের থেকে তথ্য-উপাত্তের আড়াআড়ি যাচাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।

তদন্ত অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১১ কোটি ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার ২৬২ টাকা এবং সুদ বাবদ ১৩ কোটি ৫৮ লাখ ১০ হাজার ৭৯৯ টাকাসহ সর্বমোট ২৫ কোটি ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৬১ টাকা রাজস্ব পরিহারের তথ্য উদঘাটিত হয়।

ভ্যাট গোয়েন্দার তদন্তে আরও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি সরকারের ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে নানা ধরনের জালিয়াতি ও মিথ্যার আশ্রয় নেয়, যা ভ্যাট আইন অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরে ডেল্টা লাইফের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিটির প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়ে কয়েকজন কর্মকর্তা এক বছরে প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পরিচালনা পরিষদ বাতিল হওয়ার পর দায়িত্ব পেয়েই নামে-বেনামে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তারা। কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটির সাবেক দুই প্রশাসক।

অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় প্রতিষ্ঠানটির ডিএমডি মনজুরে মাওলা ও ইভিপি ফারহান উদ্দীনকে। আদালতের স্থগিতাদেশ দেয়ার পর ফের তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। যারা এখনো বহাল তবিয়তে থেকে এসব অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের লুটপাটে বিপাকে আছেন লাখ লাখ গ্রাহক।

এত অনিয়মের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দিয়ে ঠকিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি। বছরের পর বছর এজিএম না করে, লভ্যাংশ না দিয়েও মার্কেটের ‘এ’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স।

সবকিছু ধোঁয়াশা রেখেই পুঁজিবাজারে লেনদেন চলমান রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় পুঁজি হারাতে পারেন ডেলটা লাইফের বিনিয়োগকারীরা, এমনটাই ধারণা করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।