শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম: মহামারী করোনায় গত এক বছরেরও বেশি সময়ে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৬৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এ সময়ে ডিএসইর বাজার মূলধনও বেড়েছে ৭২ শতাংশের বেশি। মহামারীতে বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ থাকায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছে, যাতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্বেগে পড়েছে।

১৯৯৬ কিংবা ২০১০ সালের মতো আবারও ধস নামে কি-না, এমন শঙ্কায় গত তিন সপ্তাহ ধরেই নানামুখী সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কিছুতেই পুঁজিবাজারের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না আর্থিক খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এমন পরিস্থিতিতে সব ধরনের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর এবার ব্যাংক ও এর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এখন থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট ছকে প্রতিদিন বিকেল ৫টার মধ্যে বিনিয়োগের তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংক, এনবিএফআই, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজ, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কী পরিমাণ তহবিল হস্তান্তর করা হয়েছে তার তথ্য প্রতিদিন আলাদা ছকে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মূলত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ তথা লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন পদক্ষেপ।

এর আগে মহামারী করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারি প্রণোদনার কম সুদের ঋণের একটি অংশ পুঁজিবাজার, জমি, ফ্ল্যাট কেনাসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে গত ২৫ জুলাই সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া প্রণোদনার আওতায় ঋণের ব্যবহারসহ বিভিন্ন তথ্য চেয়ে পরবর্তীতে আরও একটি চিঠি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ঋণের সঠিক ব্যবহার যাচাইয়ের জন্য মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনের সিদ্ধান্তও নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

পরবর্তীতে ব্যাংকে থাকা অলস অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে তুলে নিতে শুরু করে সংস্থাটি। কিন্তু কোনো পদক্ষেপেই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বরং গত ২৫ জুলাইয়ের পর ডিএসইর প্রধান সূচকটি আরও ২৭৬ পয়েন্ট বেড়েছে। ডিএসইর লেনদেন বেড়ে দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল দৈনিক ভিত্তিতে পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও এর সাবসিডিয়ারির লেনদেন ও বিনিয়োগের পাশাপাশি গ্রাহককে দেওয়া মার্জিন ঋণের প্রতিদিনের তথ্য পাঠাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল বৃহস্পতিবার সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে চিঠি দিয়ে এ নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা উদ্বৃত্ত তারল্য যেন পুঁজিবাজারসহ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে না যায় সেজন্য নিয়মিত তদারকির এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, ২০১৬-১৭ সালের দিকে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারের লেনদেন নিয়মিত তদারকির জন্য মাস ও সপ্তাহভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এরপর পুঁজিবাজার দীর্ঘ মন্দায় পড়লে এবং ব্যাংকগুলোর অংশগ্রহণ কমে গেলে এ ধরনের তথ্য নেওয়া বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। পুঁজিবাজারের উল্লম্ফনে ব্যাংক ও এর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, ২০১০ সালের পর পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো মোট দায়ের পরিবর্তে রেগুলেটরি মূলধনের মাত্র ২৫ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। সাবসিডিয়ারিসহ ব্যাংকগুলো রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে পুঁজিবাজারে বেশিরভাগ ব্যাংকের বিনিয়োগ নির্ধারিত সীমার অনেক নিচে রয়েছে বলে এসইসি সূত্রে জানা গেছে। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও পুঁজিবাজারে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।

অবশ্য মার্জিন ঋণে ব্যাংকের সাবসিডিয়ারিগুলোর অন্যতম ভূমিকা রয়েছে। পুঁজিবাজারে শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর অধিকাংশই ব্যাংক ও এনবিএফআইয়ের সাবসিডিয়ারি। বর্তমানে যে মার্জিন ঋণ রয়েছে, তার বড় অংশই এসব সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ।

চলতি বছরের শুরুতে মার্জিন ঋণ বিতরণের অনুপাত বাড়িয়ে দেওয়ার পর থেকেই পুঁজিবাজারে এর বড় প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া এসব সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানেরও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে ব্যাংকের সাবসিডিয়ারির বিনিয়োগ খতিয়ে দেখার মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রতিদিন মুদ্রাবাজার থেকে তহবিল কোথায় যাচ্ছে বা কোথা থেকে মুদ্রাবাজারে তহবিল আসছে সে-বিষয়ক তথ্য পাঠানোর জন্য ছক দেওয়া হয়েছে। ছকে ব্যাংকের নিজস্ব পোর্টফোলিওতে নতুন বিনিয়োগ, সিকিউরিটিজের মোট বিক্রয়মূল্য ও নেট এক্সপোজার পাঠানোর জন্য আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে। এ ছাড়া নিজস্ব সাবসিডিয়ারিতে প্রতিদিনের ঋণসীমা, তহবিল ছাড়, তহবিল সমন্বয় এবং নেট এক্সপোজারের তথ্য দিতে হবে। প্রতিদিনের মার্জিন ঋণের পরিমাণ, স্থিতি ও সমন্বয় জানাতে হবে।

এ ছাড়া কলমানি মার্কেটের লেনদেন ব্যতিরেকে ব্যাংক থেকে অন্যান্য ব্যাংক, এনবিএফআই, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজ, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কী পরিমাণ তহবিল হস্তান্তর করা হয়েছে তারও তথ্য দেওয়ার জন্য আলাদা একটি ছক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত তারল্য থাকায় এ নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর অলস তারল্য দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। সম্প্রতি এই অতিরিক্ত তারল্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার জন্য ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ নিলাম শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতিমধ্যে এই নিলামের মাধ্যমে বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছে সংস্থাটি।