শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৪ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ারের দর কোন কারন ছাড়াই লাগাতর বাড়ছে। যা বাজারের জন্য অশনি সংকেত। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নজরদারীতে দাপট কমছে না ঝুঁকিপুর্ণ শেয়ারগুলোর। এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও এক ধরনের আশঙ্কা কাজ করছে।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন বাজার নিয়ে বারবার কারা খেলছে। তাদের আসল উদ্দেশ্য কি এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত। এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীল করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা যার যতটুকু সাধ্য তা নিয়ে চেষ্টা করছেন।

কিন্তু তারপরও কোথাও যেনো একটি গলদ থেকে যাচ্ছে এবং বাজার উঠতে গেলেই একটি অদৃশ্য শক্তি সূচকের পেছন থেকে নিচের দিকে টেনে ধরে। মূলত এই অদৃশ্য শক্তিটিই বার বার পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে। ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধ্বসে এদের সক্রিয়তা ছিল। এদের কারনে নিংস্ব হয়েছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীরা।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএসইসিতে নাকি অত্যাধুনিক সার্ভিল্যান্স সফটওয়্যার আছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বসানো হয়েছে এ সফটওয়্যার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সফটওয়্যারের কাজ কি? সবচেয়ে বড় কথা হলো যা খালি চোখে দেখলেই অস্বাভাবিক মনে হয় তার জন্য সার্ভিল্যান্সেরই কি প্রয়োজন?

এদিকে আজ সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে চারটি কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক দর বাড়ে। এর মধ্যে চারটি কোম্পানি লোকসানি। তারা বছরের পর বছর ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না। এরমধ্যে তিনটি কোম্পানি গত ১০ বছরে কখনও লভ্যাংশ দিতে পারেনি, সামনে দিতে পারবে এমন সম্ভাবনাও কম। বিপুল পরিমাণ লোকসান, শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য ঋণাত্মক, এই অবস্থাতেও কোম্পানিগুলোর দাম ১০ শতাংশ বাড়ছে।

আরামিট সিমেন্ট: আরামিট সিমেন্ট গত ৫ বছর ধরে লভ্যাংশ দিচ্ছে না। বাড়ছে ঋনের বোঝা, তেমনি বাড়ছে লোকসানের পরিমান। তারপর টানা দর বাড়ছে। গত ১ মাসের ব্যবধানে ১৭ টাকা থেকে গতকাল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ২৭.৯০ পর্যন্ত লেনদেন হয়।

এদিকে গত এক মাসে শেয়ারের দাম প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি। তবে গত সপ্তাহে দাম বাড়ার ক্ষেত্রে দাপট দেখিয়েছে পচা ‘জেড’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আরামিট সিমেন্ট। কোম্পানিটির শেয়ার গত সপ্তাহজুড়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে পছন্দের শীর্ষ স্থানে ছিল। এর ফলে দাম বাড়ার শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার।

ক্রেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসায় গত সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ১২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বেড়েছে ৪ টাকা ৬০ পয়সা। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস শেষে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ২৬ টাকা ৮০ পয়সা, যা আগের সপ্তাহের শেষে ছিল ২০ টাকা ৮০ পয়সা।

শেয়ারের এমন দাম হলেও ১৯৯৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এই কোম্পানিটির লভ্যাংশের ইতিহাস খুব একটা ভালো না। ২০১৬ সালে বিনিয়োগকারীদের ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়া কোম্পানিটি এরপর আর কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। ফলে শেয়ারবাজারের পচা ‘জেড’ গ্রুপে স্থান হয়েছে কোম্পানিটির।

চলমান হিসাব বছরেও কোম্পানিটি খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। ২০২০ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৯ পয়সা মুনাফা দেখালেও, ছয় মাসের (২০২০ সালের জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ২৩ পয়সা লোকসানে রয়েছে।

ঝিলবাংলা সুগার: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি ঝিলবাংলা সুগার গত ১০ বছরে লভ্যাংশ দেয়নি। এ শেয়ারের গত বছরের মাঝামাঝিতে ৪০ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ২ শত টাকায় উঠে। এর পর দরপতন শুরু হলে ১১২ এসে দাঁড়ায়। গতকাল দিনশেষে ১০ শতাংশ বাড়ছে শেয়ারটির দর। কিন্তু রোববার এই কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এই কোম্পানির মূল্যসীমা অনুযায়ী ১০ শতাংশের বেশি বাড়ার সুযোগ নেই।

কিন্তু শতাংশের হিসাবে কখনও ১০ এর নিচেই থাকে সর্বোচ্চ দর বৃদ্ধির হিসাবটি। জিলা বাংলা সুগার মিলের খোঁজখবর দেয়ার জন্য দায়িত্বে থাকা কোম্পানি সচিব লাইলি আক্তারও অবাক হয়েছে যখন জেনেছেন শেয়ারের দর বেড়েছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি।

তিনি বলেন, ‘এটা কীভাবে সম্ভব? কোম্পানির যেমন ছিল এখন তেমনি আছে। কোনো অগ্রগতির খবর নেই।’ তিনি বলেন, ‘লোকসানে থাকায় লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের। কিন্ত তারপরও কেন শেয়ারের দর এভাবে বাড়ছে তা জানা নেই।

সাভার রিফ্যাক্টরিজ লিমিটেড : জেড ক্যাটাগরির আরেক কোম্পানি সাভার রিফ্যাক্টরিজ লিমিটেড। বিবিধ খাতে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানিটি ১৯৮৮ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলেও লভ্যাংশ দেয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারপরও বিনিয়োগকারীদের পছন্দের তালিকায় থাকা এই কোম্পানির শেয়ার দরও রোববার বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এমন খবরে কোম্পানির সচিব বেলায়েত হোসেন খানও হতবাক হয়ে প্রশ্ন করেছেন, ‘আজও দাম বেড়েছে?’

তিনি বলেন, ‘কিছু ব্যক্তি আছে যারা এ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায়। আমরা তাদের সম্পর্কে জানি না। তবে কোম্পানির কোনো অপ্রকাশিত তথ্য নেই যার কারণে শেয়ারের দর বাড়তে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির আগের সমস্যাগুলো এখনও আছে। কাঁচামাল কিনতে না পারা, পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকা, চেষ্টা করা হচ্ছে ভালো কিছু করার। কিন্ত কতটুকু হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।’

শ্যামপুর সুগার: রোববার জেড ক্যাটাগরির এই দুই কোম্পানি নয়, ছিল শ্যামপুর সুগার মিল, যার শেয়ার প্রতি দর বেড়েছে ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে প্রায়ই কারসাজি হয়। যখন পুঁজিবাজারে টানা নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়, তখনই এই ঘটনাটি ঘটে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুর্বল কোম্পানিগুলোকে শুধু পরিদর্শনই নয়, বাজারের স্বচ্ছতায় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এরপর কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। এ সংকট কাটাতে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্বল কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তার মধ্যে অন্যতম।
তিনি আরও বলেন, এসব কোম্পানি বছরের পর বছর কোনো লভ্যাংশ দেয় না। হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই দাম বাড়ে। কয়েক দিন পর আবার বড় দরপতন হয়। ফলে এগুলো তালিকাচ্যুত করে বাজারে একটি বার্তা দেয়া দরকার।