শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের বিতর্কিত কোম্পানি সী পার্ল রিসোর্ট লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ বিনিয়োগকারীদের জন্য মাত্র এক শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তবে কোম্পানির ঘোষিত ডিভিডেন্ড বিনিয়োগকারীদের হতাশ করছে। কোম্পানিটি তালিকাভুক্তির ২ বছরের মাথায় ডিভিডেন্ডের এমন কান্ড থেকে বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভ জানিয়েছেন। পাশাপাশি কোম্পানিটি হিসাব খতিয়ে দেখা উচিত।

৩০ জুন ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই লভ্যাংশ ঘোষণা করে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। নানা গোজামিলে মুনাফা ফুলিয়ে অতিরঞ্জিত আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। তালিকাভুক্তির প্রথম বছরে অর্থাৎ ৩০ জুন ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরে ৫ শতাংশ বোনাস দিয়ে বি ক্যাটাগরিতে নাম লেখালেও এবার ভরাডুবি হল কোম্পানিটির।

বিভ্রান্তিকর ও ভুতুড়ে তথ্য দিয়ে দুর্বল সী পার্ল রিসোর্টের ২০১৯-২০ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ০.০৯ টাকা লোকসান দিয়েছে। চলতি বছরের ৩০ জুন কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) দাঁড়ায় ১০.০৬ টাকা। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রথম বছরেই কোম্পানিটির ভরাডুবি হল। তালিকাভুক্তির আগেই কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে বিশ্লেষকরা নেতিবাচক হবে বলে শঙ্কা করেছিলেন। বিশ্লেষকদের সেই কথাই বাস্তব প্রমাণিত হল।

ঘোষিত লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের সম্মতি অনুমোদনের জন্য কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম)আগামী ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। লভ্যাংশ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট ১৯ নভেম্বর।

পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের জন্য বিভ্রান্তিকর ও ভুতুড়ে তথ্য দিয়ে প্রসপেক্টাস তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে সী পার্ল বিচ রিসোর্ট আন্ড স্পা লিমিটেডের। আর পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানটির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে।

বিএসইসি’র কাছে জমা দেয়া সি পার্ল বিচ রিসোর্ট আন্ড স্পা’র প্রসপেক্টাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শেয়ার প্রতি আয়ের (ইপিএস) বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি একেক স্থানে একেক রকম তথ্য দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির হোটেল রুমের বিষয়ে রয়েছে ভুতুড়ে তথ্য। আবার দুই বছর আগে লোকসানের মধ্যে থাকলেও আইপিও আবেদনের আগেই প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় বড় ধরনের উলম্ফন হয়েছে।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আইপিও’র প্রসপেক্টাসে ইপিএস এক এক পৃষ্ঠায় এক এক রকম দেখানোর সুযোগ নেই। এমনটি হলে ধরে নিতে হবে প্রতিষ্ঠানটি মনগড় আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কোনো প্রতিষ্ঠান এমন তথ্য দিলে, সেই প্রতিষ্ঠানের আইপিও কিছুতেই অনুমোদন দেয়া উচিত নয়। তবে সবকিছু ম্যানেজ করে ঠিকই অনুমোদন নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জানা গেছে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায়ে ময়মনসিংহের এক সাবেক মেয়র রয়েছেন পরিচালক পদে। তাদের ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠানটি বিএসইসির অনুমোদন নিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের জন্য যদি প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়, তাহলে ওই কোম্পানির সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পুঁজিবাজারের বিকাশে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া উচিত। তবে সেই কোম্পানির অবশ্যই আর্থিক স্বচ্ছতা ও ফান্ডামেন্টাল (মৌলিক) অবস্থা থাকতে হবে।

তাদের মতে, একের পর এক দুর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। ফলে আইপিওতে আসার সময় কোম্পানিগুলোর মুনাফায় বড় ধরনের উলম্ফন দেখা গেলেও তালিকাভুক্ত হওয়ার পর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে দুর্বল ও গোজামিল তথ্য দিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা কোম্পানিকে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দিলে তা বাজারের জন্য ক্ষতিকর।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, গত পাঁচ বছরে অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে যাদের বর্তমান আর্থিক চিত্র দেখলেই বোঝা যায় অধিকাংশ কোম্পানি প্রসপেক্টাসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাজারে এসেছে। মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম নিয়ে আসা কোম্পানির দাম মাত্র ৬ টাকায় নেমে যাওয়ার ঘটনাও আমরা দেখতে পারছি। এভাবে দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে আজ পুঁজিবাজারের এমন দশা।

রিসোর্টের বিভিন্ন কক্ষের ইনটেরিয়র, ফিনিশিং ও আসবাবপত্র ক্রয়, জমি ক্রয় ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের খরচ খাতে ব্যয় করতে সী পার্ল বিচ রিসোর্ট আন্ড স্পাকে পুঁজিবাজার থেকে ১৫ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। এজন্য ১০ টাকা অভিহিত মূ্ল্যে কোম্পানিটি আইপিওতে এক কোটি ৫০ লাখ সাধারণ শেয়ার ছাড়ে।

এ লক্ষ্যে কোম্পানির তৈরি করা প্রসপেক্টাসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রসপেক্টাসের ২৪১ পৃষ্ঠায় ২০১৮ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের ডাইলোটেড ইপিএস দেখানো হয়েছে ৫৬ পয়সা। একই ইপিএস ২৪৩ পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে ৪৬ পয়সা। অর্থাৎ দুই স্থানের ইপিএস’র মধ্যে ১০ পয়সার ব্যবধান রয়েছে।

এদিকে প্রসপেক্টাসের ২৩১ পৃষ্ঠায় প্রতিষ্ঠানটি হোটেল রুমের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ৮১ হাজার ২৪৯টি। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ৪৯ হাজার ৬৬০টি রুম বা ৬১ দশমিক ১২ শতাংশ ইউটিলাইজ (ব্যবহার) হয়েছে।

হোটেলটির রুম বুকিংয়ে দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, তাদের ৪৯৩টি গেস্ট রুম আছে, এর মধ্যে ২৪১টি ভাড়া দেয়া হয়। মানভেদে এক একটি রুমের ভাড়া ১২ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, শ্রমিকদেরও ঠকিয়েছে কোম্পানিটি। একই সঙ্গে শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। কোম্পানিটি ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিট আয়ের ৫ শতাংশ হারে ফান্ড গঠন ও বিতরণ- কোনোটাই করেনি। ফলে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে আইপিও আবেদনের আগে ২০১৮ সালে ফান্ড গঠন করেছে।

আইপিওতে আসার আগে কোম্পানিটির মুনাফায়ও বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬০ লাখ ৬১ হাজার টাকা লোকসান করলেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা মুনাফা হয়েছে বলে প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মুনাফা আরও বেড়ে হয়েছে ১৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো কোম্পানির মুনাফায় একটি ধারাবাহিকতা থাকে। হঠাৎ করে লোকসান আবার হঠাৎ করে বড় মুনাফা হওয়ার ঘটনা সাধারণত ঘটে না। তবে লোকসান থেকে মুনাফায় ফেরা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু লোকসান থেকে হঠাৎ করেই বড় ধরনের মুনাফা হলে তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।

এদিকে ২০১৭ সালে কোম্পানিটির ৩২০ কোটি ২৮ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদের ঋণ থাকলেও ২০১৮ সালে তা মাত্র দুই কোটি ২৩ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। এ ঋণ কমাতে কোম্পানিটি ৩৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকার বন্ড ছেড়েছে। বন্ড ছেড়ে সংগ্রহ করা অর্থও একটি দীর্ঘমেয়াদের ঋণ। অর্থাৎ বন্ড ছেড়ে কোম্পানিটি দীর্ঘমেয়াদের ঋণ কমিয়ে দেখিয়েছে।

বন্ড ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদের ঋণ কমানো হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারহোল্ডার ইক্যুইটির প্রায় চার গুণ বিভিন্ন মেয়াদের ঋণ রয়েছে। ১০৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার ইক্যুইটির বিপরীতে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ ৩৬২ কোটি ৭ লাখ টাকা।

এমন বিপুল পরিমাণ ঋণকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিপুল অঙ্কের এ ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে গিয়ে কোম্পানিটির মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে।

এদিকে যোগাযোগ ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, একই ইপিএস পৃষ্ঠাভেদে ভিন্ন হওয়ার সুযোগ নেই। কোনো কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন ইপিএস দেখালে সেখানে সমস্যা থাকতে পারে। আর বন্ড ছেড়ে অর্থসংগ্রহ করা খারাপ নয়। তবে বন্ডও একটি দীর্ঘমেয়াদের ঋণ, তাই কী উদ্দেশ্যে বন্ড ছাড়া হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত।

ইক্যুইটি ও ঋণের চিত্র তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, ১০৪ কোটি টাকা ইক্যুইটির বিপরীতে ৩৬২ কোটি টাকা ঋণ হলে, সেটা বেশিই মনে হচ্ছে। ব্যবসার স্বার্থে ঋণ নেয়া যেতে পারে। তবে ঋণ যত কম থাকে ততোই ভালো। ঋণের পরিমাণ বেশি হলে কোম্পানিকে মোটা অঙ্কের সুদ টানতে হবে।