শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে লোকসানের পর এবার অবশিষ্ট পুঁজি নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। যেসব ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করে থাকেন, সেই সব প্রতিষ্ঠানই গ্রাহকদের অর্থ ও শেয়ার আত্মসাৎ করছে। সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাৎ করে ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিকের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার পর আরও কিছু ব্রোকারেজ হাউজে সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি পেয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। আইন ভেঙে বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউজ গ্রাহকদের জমা রাখা অর্থ নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে।

সম্প্রতি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার দেনা নিয়ে পালিয়ে যান ডিএসইর সদস্য প্রতিষ্ঠান ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক মো. শহিদ উল্লাহ। এ ঘটনার পর অন্যান্য ব্রোকারেজ হাউজে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ জমা নিরাপদে রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট হাউজগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে পাঠায় ডিএসই। একই সঙ্গে ডিএসইর রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন (আরএডি) বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে তাৎক্ষণিক পরিদর্শন চালায়।

এমন পরিদর্শনে ডিএসই সদস্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্য তিনটি সিকিউরিটিজ হাউস “রেড জোন” বা বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। সিকিউরিটিজ হাউস তিনটিতে কনসুলেটেড কাস্টমার অ্যাকাউন্ট (সমন্বিত গ্রাহক হিসাব) ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ফলে এ তিনটি হাউজের বিনিয়োগকারীরা পুঁজি নিয়ে দু:চিন্তায় রয়েছেন। সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক হওয়ার অর্থ, সিকিউরিটিজ হাউস কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের অগোচরে তার টাকা তুলে নিয়েছে।

ফলে ওই সিকিউরিটিজ হাউসের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা মানে, বিনিয়োগকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক হয়ে পড়া তিন সিকিউরিটিজ হাউসের মধ্যে রয়েছে- সিনহা সিকিউরিটিজ লিমিটেড, ইন্ডিকেট সিকিউরিটিজ কনসালট্যান্ট লিমিটেড এবং আল-মুনতাহা ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র বলছে, সিকিউরিটিজ হাউস তিনটির মধ্যে সিনহা সিকিউরিটিজের অবস্থা বেশি খারাপ। প্রতিষ্ঠানটিতে সমন্বিত গ্রাহক হিসাব মোটা অংকে ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক থাকার পাশাপাশি ইন্ডিকেট সিকিউরিটিজ কনসালট্যান্ট লিমিটেডে মালিকানা দ্বন্দ্ব চলছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ডিএসইর কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, সবগুলো হাউজ পরিদর্শন করা হলে এমন ঘটনা আরও পাওয়া যাবে। তবে ব্রোকারেজ হাউজ পরিদর্শনে গিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের চাপের মুখে রয়েছেন ডিএসইর কর্মকর্তারা। এসব পরিদর্শনের রিপোর্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (এসইসি) পাঠানোর পাশাপাশি ডিএসইর পর্ষদ সভায়ও উত্থাপন করা হয়েছে।

ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিকের পালানোর পর ডিএসই গত কয়েক দিনে অন্তত ৯টি ব্রোকারেজ হাউজে পরিদর্শন চালিয়েছে। এর মধ্যে সিনহা সিকিউরিটিজের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ৮ কোটি টাকার ঘাটতি পাওয়া গেছে। এর বাইরে আরও দুটি সিকিউরিটিজ হাউজে কোটি টাকার ঘাটতি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এসব ব্রোকারেজ হাউজ গ্রাহকদের জমা রাখা অর্থ নিজেদের প্রয়োজনে সরিয়ে নিয়েছে, যা সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ক্রেস্ট সিকিউরিটিজ ছাড়াও এর আগে শাহ মোহাম্মদ সগির, ডন সিকিউরিটিজ, সিলেট মেট্রো সিটি, ট্রেনসেট সিকিউরিটিজ, মহররম সিকিউরিটিজসহ ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের অন্তত ১০টি ব্রোকারেজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছে। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বিনিয়াগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের কারণে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সদস্য প্রতিষ্ঠান মহররম সিকিউরিটিজের লেনদেন স্থগিত রেখেছে।

সূত্রটি আরও জানায়, ওই তিন সিকিউরিটিজ হাউসের পাশাপাশি আরও প্রায় শতাধিক সিকিউরিটিজ হাউস সমস্যায় রয়েছে। এসব হাউস থেকেও গ্রাহকদের অগোচরে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। তবে তার পরিমাণ তুলনামূলক কম। সম্প্রতি ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শহিদ উল্লাহ আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সিকিউরিটিজ হাউসগুলোর চিত্র খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব তথ্য পেয়েছে ডিএসই। গত ২ জুন অনুষ্ঠিত ডিএসইর পরিচালনাপর্ষদ সভায় এ তথ্য উপস্থাপন করা হলে কয়েকজন পরিচালক উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

এদিকে ডিএসইর কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ পরিদর্শনে গিয়ে নানা রকমের চাপের মুখে পড়েছেন। স্টক এক্সচেঞ্জটির প্রভাবশালী সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিচ্ছেন, পরিদর্শনে বাধা তৈরি করছেন। আবার ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের ঘটনার পর বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ পরিদর্শন করে সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতির বিষয়টি ডিএসইর পর্ষদ সভায় প্রেরণ করা হলেও তা আমলে নিচ্ছে না পর্ষদ। যদিও এসইসির চেয়ারম্যান রুবাইয়াত-উল-ইসলাম দেশ প্রতিক্ষণকে জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব ডিএসইর।

যোগাযোগ করা হলে ডিএসই”র এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, তিনটি সিকিউরিটিজ হাউসের সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক থাকার তথ্য আমরা পেয়েছি। একটি সিকিউরিটিজ হাউসের সমন্বিত গ্রাহক হিসাব ঋণাত্মক হয়ে গেলে ওই হাউসের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা বিনিয়োগকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।

“ধরেন, আমার সিকিউরিটিজ হাউসে ১০ জন বিনিয়োগকারীর ১০ লাখ টাকা আছে। এখান থেকে আমি পাঁচ লাখ টাকা তুলে নিলাম। এভাবে টাকা তুলে নিলে একজন বিনিয়োগকারীর পক্ষে তা জানা অসম্ভব। কারণ, একজন বিনিয়োগকারী হাউসে গেলে তাকে একটা স্টেটমেন্ট দেয়া হয়। তাতে টাকা জমার পরিমাণ এবং শেয়ার কেনার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়। সিকিউরিটিজ হাউস মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্টেটমেন্ট তৈরি করে দিলে বোঝার কোনো উপায় নেই।”

এ সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, প্রত্যেক বিনিয়োগকারীকে তার বেনিফিসিয়ারি ওনার অ্যাকাউন্ট (বিও হিসাব)-এর বিপরীতে একটি করে মোবাইল নম্বর সংযুক্ত করে দিতে হবে। যাতে ওই বিও হিসাবে কোনো লেনদেন হলে গ্রাহকের কাছে অটোমেটিক এসএমএস চলে যায়, তাহলেই বিনিয়োগকারীরা তাদের হিসাবে কোনো লেনদেন হলে তার তথ্য পেয়ে যাবেন। তিনি আরও বলেন, সিকিউরিটিজ হাউসের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবের স্টেটমেন্ট ডিএসই”র কাছে থাকে। কিন্তু কেউ যদি স্টেটমেন্ট ম্যানুপুলেট করে তাহলে ধরা কঠিন। এক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ হাউসের স্টেটমেন্টের সঙ্গে ব্যাংকের স্টেটমেন্ট মিলিয়ে দেখতে হবে। দুই স্টেটমেন্ট যদি না মিলে তাহলে বুঝতে হবে ঘাপলা আছে।

ডিএসইর এক কর্মকর্তা বলেন, শতাধিক সিকিউরিটিজ হাউসের মধ্যে সমন্বয় আছে। এসব সিকিউরিটিজ হাউস থেকে বিনিয়োগকারীদের অগোচরে টাকা উঠিয়ে নেয়ার ঘটনাও আছে। তবে তিনটি হাউসের অবস্থা বেশি খারাপ। ডিএসই থেকে সব সিকিউরিটিজ হাউসের প্রকৃত চিত্র খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।