sharebazar lagoশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথকীকরণ) সম্পন্ন হলে বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের পুঁজিবাজারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তাদের সে প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।

গত ডিসেম্বরে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন সম্পন্ন হলেও বাজারে আজও গতি ফিরে আসেনি। পতনের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে বাজার। দেশি বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কমে যাচ্ছে তাদের শেয়ার কেনার পরিমাণ। এর সঙ্গে কমছে নিট বিনিয়োগ। এছাড়া দীর্ঘ মন্দার কারণে বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

সিকিউরিটিজ হাউসগুলোতে বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বিনিয়োগকারী না থাকায় হাউসগুলোতে খাঁ খাঁ অবস্থা বিরাজ করছে। বড় ধরনের উল্লম্ফনের পর ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামে পুঁজিবাজারে। সরকারসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানা উদ্যোগেও বাজারে আর গতি ফেরেনি।

মাঝে মধ্যে নানা ইস্যুতে বাজারে কিছুটা গতি ফিরলেও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আবার পতন ধারায় ফিরে গেছে। বলতে গেলে গত ৬ বছর ধরে মন্দার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে বাজার। এমন পরিস্থিতিতে পুঁজি খুইয়ে বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করলেও নতুন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি মতিঝিলের কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাউসগুলো প্রায় ফাঁকা। বেশির ভাগ চেয়ারই তুলে রাখা হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটা চেয়ার পাতা থাকলেও বসার মতো বিনিয়োগকারী নেই। এটি আজ রোববার চিত্র নয়। ছয় বছর ধরেই এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে সিকিউরিটিজ হাউসগুলোতে। মাঝে মধ্যে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি কিছুটা বাড়লেও আবারও শূন্য হয়ে পড়ছে।

অথচ ২০০৯ ও ২০১০ সালে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতিতে গমগম করত হাউসগুলো। ধস শুরু হওয়ার আগে বসার জায়গা পেতে রীতিমতো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত। লেনদেন শুরুর অনেক আগেই হাজির থাকতেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তাদের। নতুন নতুন শাখা খোলা শুরু হয়।

ইলেক্ট্রনিক শেয়ার সংরক্ষণ ও লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপেজটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) এ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৩৩ লাখ। গত সাড়ে ৫ বছরে এ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ কমে দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখে। ৩২ লাখ বিও এ্যাকাউন্টধারী বিনিয়োগকারী থাকলেও বাজারের প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। আর আগ্রহ না থাকার কারণে তারা বাজারমুখীও হচ্ছেন না।

ডিএসইর তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর সাধারণ সূচক ছিল ৮৯১৮ পয়েন্ট। আর ওইদিন লেনদেন হয় ৩ হাজার কোটি টাকা। সাড়ে ৫ বছর পর এখন লেনদেন নেমে এসেছে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, শেয়ারবাজার ভাল হবে এমন আশাবাদ নিয়ে অপেক্ষা করেছেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু বার বার তারা আশাহত হয়েছেন। এ কারণে বাজারের প্রতি তাদের আগ্রহ একেবারে কমে গেছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের হাউসে আসাও কমে গেছে। তবে পুরোনো বিনিয়োগকারীদের অনেকেই মোবাইলে লেনদেন করছেন বলে জানান তিনি।

বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ডিএসইর সাবেক পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই নাহরীন বলেন, পুঁজিবাজারের উন্নতির কোন লক্ষণ নেই। তাই বিনিয়োগকারীরা তাদের লোকসান মেনে নিয়ে বাজার থেকে চলে যাচ্ছে। অথচ নতুন বিনিয়োগকারী আনার ব্যবস্থা না করে একের পর এক নতুন কোম্পানি বাজারে আনা হচ্ছে। এতে চাহিদার অভাবে সেকেন্ডারি মার্কেটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়টা বুঝতে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

তাই নতুন কোম্পানি আনার ক্ষেত্রে সবার আগে পুঁজিবাজারে অবাধ অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, অনেকেই বলেন নতুন শেয়ার নতুন বিনিয়োগকারী সৃষ্টি করে। অথচ ২০১০ সালের পরে ৭৭টা কোম্পানি আনা হলেও লেনদেন আগের জায়গায় তো নেই বরং আরও কমেছে। তাহলে নতুন বিনিয়োগকারী আসল কী ভাবে?’ তিনি বলেন, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আয়-ব্যয় সমান হতে ডিএসইতে দৈনিক ৬০০ কোটি টাকার লেনদেন হওয়া দরকার। অথচ এখন হয় ৩০০ কোটি টাকা।

আনোয়ার সিকিউরিটিজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আজম খান বলেন, ২০১০ সালে যে ধস হয়েছে তা থেকে পুনরুদ্ধার হয়নি। বাজারে এখনও মন্দা বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ কমে গেছে। যাতে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি কমে গেছে। বর্তমানে যে পরিমাণ লেনদেন হচ্ছে তাতে হাউসগুলোর পক্ষে মুনাফা করা সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির বাণিজ্য অনুষদের প্রধান মোহাম্মদ মূসা বলেন, ‘একটি দক্ষ পুঁজিবাজারের জন্য দরকার অধিক সংখ্যক ক্রেতা-বিক্রেতার অংশগ্রহণ। তাই ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা যত বাড়বে তা বাজারের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

আর আমাদের বাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাতে করে দক্ষ বাজার গড়ে তোলার পথে আমরা পেছনের দিকেই হাঁটছি। আর যাঁরা চলে যাচ্ছেন তাঁরা তো বাজারের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করছেন। পাশাপাশি তাঁরা অন্যদের যে বার্তাটি দিচ্ছেন সেটি হলো, বাজারে কোনো আশা নেই। তাই তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন। এর ফলে যেটি হবে তা হলো নতুন করে বাজারে আসার ব্যাপারে অন্যদের তেমন আগ্রহ তৈরি হবে না।