শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র কোম্পানিগুলোর দ্বিতীয় প্রান্তিকের ব্যবসায় বিপর্যয় ফুটে উঠেছে। বাড়তি ব্যয়ে ঝুঁকিতে পড়ছে বস্ত্র খাত। কাঁচামাল, জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার কারণে সংকটে রয়েছে দেশের পোশাক শিল্প। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির নিট মুনাফা কমেছে। ফলে বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত প্রায় সব কোম্পানিই শেয়ারদর হারিয়েছে।

এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের শেয়ার ছেড়ে যাচ্ছে বিদেশিরা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ কমছে এসব শেয়ারে। প্রত্যাশিত মুনাফা না পেয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও হতাশ। মন্দা বাজারে এ খাতের বেশ কিছু কোম্পানির দর ফেস ভ্যালুর নিচে। সব মিলিয়ে বস্ত্র খাতের কোম্পানিগুলোর বেহাল দশা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিনিয়োগকারীরা আশানুরূপ গেইন করতে না পারায় আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ভালো পারফরমেন্সের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্ভব।

অন্যদিকে বাংলাদেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। নানা রকম নিত্যপণ্যসহ তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য চীনের প্রতি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। দেশটির এই ‘একঘরে’ হয়ে পড়া মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে। এ দেশের তৈরি পোশাক খাতে যে কাঁচামাল আসে, তার প্রায় ৬০ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করা।

নিটওয়্যার খাতেও প্রায় ১৫ শতাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। কাপড়, পলি, জিপার, কার্টন, লেস, হ্যাঙ্গার, বোতাম; রঙ ও প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এবং আরও অনেক এক্সেসরিজই আমদানি করা হয় চীন থেকে।

করোনার কারণে বর্তমান অচলাবস্থার ফলে কারখানাগুলো চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। শিগগিরই এর অবসান না হলে এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা। চীন থেকে যে সব কাঁচামাল আমদানি হতো, সেগুলোর দাম দেশের বাজারে ইতোমধ্যেই ৩-৪ গুণ বেড়ে গেছে। সামনে এর চেয়েও বড় সংকট আসছে। তা মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বাংলাদেশের পক্ষে। অনেকেই হয়তো ধারণাই করতে পারছেন না, সামনে কতটা মারাত্মক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে, বলেন তারা।

পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোয় সর্বোচ্চ এক মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকে। আর বড় কারখানাগুলোয় বড়জোর দুই থেকে আড়াই মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে আমদানি বন্ধ থাকলেও এতদিন ধরে উৎপাদন চলায় অনেক কারখানারই মজুদ ফুরিয়ে গেছে, যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, চীন থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় দেশের রপ্তানি খাতেও নেমে আসছে বিপর্যয়। অচিরেই মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের পুরো রপ্তানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছি।

আল্লাহর কাছে মুক্তি চাই। তিনি বলেন, পুরো চেইনটাই ভেঙে গেছে। পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের পণ্য আমদানি বন্ধ। এ কারণে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। সময়মতো ক্রেতাদের চাহিদা তো পণ্য রপ্তানি করা যাবে না। রপ্তানিও বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের বাজারে ডায়িং-প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার্য কাঁচামাল যেমন- রঙ, রাসায়নিক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।

তবে এমন পরিস্থিতিতেও কিছু আশার দিকও দেখছেন মোহাম্মদ হাতেম। এ উদ্যোক্তা বলেন, অনেক বায়ার চীনের অর্ডার বাতিল করেছে। তারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনার কথা ভাবছেন; যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এর পর তিনি এ প্রশ্নও রাখেন যে, অর্ডার পেলেই বা কী হবে? পণ্য উৎপাদন করতে না পারলে সরবরাহ করা তো সম্ভব নয়। পণ্য তৈরির কাঁচামালই তো বন্ধ।

চীনের কাঁচামাল ব্যবহারকারী ওভেন পোশাক কারখানার উদ্যোক্তা অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু বলেন, কাঁচামাল আনার এলসি দেওয়া আছে, কিন্তু পণ্য আসছে না। আমদানি বন্ধ। তার কারখানার জন্য ৩০ জানুয়ারি পণ্য আসার কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে পণ্য আর আসেনি।

সাদমা ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, প্রত্যেক মাসেই, বিশেষ করে মাসের শেষ সপ্তাহে চীন থেকে পণ্য আসে। জানুয়ারির শেষদিকেও আসার কথা ছিল, আসেনি। আর চলতি ফেব্রুয়ারী মাসেও আসার সম্ভাবনা দেখছি না। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। বড় কারখারখানাগুলোও বেশি দিন টিকতে পারবে না।

এদিকে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান বলেন, দেশীয় বাজারে কাঁচামালের দাম ৩-৪ গুণ বেড়ে গেছে। সবাই উদ্বিগ্ন। ওভেন পোশাকের ২০-৩০ শতাংশ দেশীয় বাজারে উৎপাদন হয়, ৭০-৮০ শতাংশই চীন থেকে আসে। এ বিশাল পরিমাণ কাঁচামাল আপাতত বাংলাদেশে উৎপাদন করা সম্ভব না। এ ছাড়া চীনের পণ্যের দাম দেশীয় কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দামের চেয়ে অনেক কম পড়ে।

তিনি বলেন, চীনা নববর্ষের আগে যেসব এলসি খোলা হয়েছিল দেশটি থেকে পণ্য আমদানির, সেগুলোর বিপরীতে অনেক পণ্য আসেনি। যেসব পণ্য এসেছে, তা বন্দরে আটকা পড়ে আছে। চীনের কোম্পানিগুলো ছুটির পর ডকুমেন্ট পাঠানোর কথা। কিন্তু অফিস বন্ধ থাকায় ডকুমেন্টস পাঠাতে পারছে না। ফলে বন্দরে ডকুমেন্স দেখাতে না পারায় পণ্য খালাস হচ্ছে না। ব্যাংকেও ডকুমেন্টস জমা দিতে পারছে না। পাশাপাশি এলসি খোলার আগে যে প্রাথমিক নথিপত্র দিতে হয়, তাও চীনে পাঠানো যাচ্ছে না। মোটকথা, পুরো চেইনটাই ভেঙে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চীনের ওপর সর্বাধিক নির্ভরশীল বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে শুধু চীন থেকেই আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকার পণ্য। অর্থাৎ মোট আমদানির ২৬ শতাংশের বেশি হয়েছে চীন থেকে। দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রায় ১৫ শতাংশ আমদানি হয়েছে ভারত থেকে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি কমেছে ৩ শতাংশ এবং রপ্তানি কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। চীনের এ সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি আরও কমবে। এতে দেশের রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেবে।

চীন থেকে মূলত পোশাকশিল্পের কাঁচামাল, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, সরকারি প্রকল্পের সরঞ্জামাদি, আদা-রসুন, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য আসে চীন থেকে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের কাঁচামাল ফেব্রিকস, রাসায়নিক পদার্থ, কারখানার যন্ত্রপাতির প্রধান উৎস চীন।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক জানান, চীনের কারোনা ভারাইস আতঙ্কে বাংলাদেশের পোশাক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ওভেন পোশাকের কাঁচামালের বড় একটি অংশ আমদানি হয় চীন থেকে। বর্তমানে চীনের শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় কাঁচামাল আসতে পারছে না।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, চীনা নববর্ষ উপলক্ষে ছুটিশেষে ২ ফেব্রুয়ারী দেশটিতে কল-কারখানা ফের চালুর কথা ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ছুটি আরও ১০ দিন বাড়ানো হয়। চীন সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত কল-কারখানা ও অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে। এ ছুটি আরও বাড়বে কিনা, তা নির্ভর করছে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, স্পর্শকাতর এ ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ফেব্রুয়ারী মাসজুড়েই বন্ধ থাকবে চীনের সব প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানা। গতকাল প্রাপ্ত তথ্যমতে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। দেশটিতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শুধু আফ্রিকা ছাড়া সব মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। এ ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় এখনো পর্যন্ত কোনো ওষুধের নির্দেশনা দিতে পারেনি চিকিৎসাবিজ্ঞান।