পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ৪৫০০ কোটি টাকা উধাও, পুঁজিবাজারের ইতিহাসে নজির বিহীন ঘটনা
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে প্রশাসক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় গভর্নর আশ্বস্ত করলেও বিনিয়োগকারীদের নিরাশ করেছেন। গত বুধবার সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, একীভূত হওয়া ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুইটির মূল্য এখন নেগেটিভ। তাই শেয়ারের ভ্যালু জিরো বিবেচনা করা হবে। কাউকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। এমন ঘোষণার পরদিন গত বৃহস্পতিবার একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এমন ঘোষণায় পথে বসেছেন বিনিয়োগকারীরা।
ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঘোষণায় কার্যত উধাও হয়ে গেল পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, এসব ব্যাংকের শেয়ারের আর কোনো মূল্য নেই। ফলে নতুন একীভূত ব্যাংকে বিনিয়োগকারীদের কোনো অংশ থাকবে না, আর আগে অগ্রাধিকার পাবেন কেবল আমানতকারীরা। একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো হলো: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বুধবার জানান, একীভূত ব্যাংকে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো অংশ দেওয়া হবে না। কারণ ব্যাংকগুলোর শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) ঋণাত্মক, যা মাইনাস ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলোর দায় সম্পদের চেয়ে অনেক বেশি। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে বলেছিল, একীভূতকরণে শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন গুজব ভিত্তিহীন। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণার পর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে।
ডিএসইর সূত্র মতে, আলোচ্য ব্যাংকগুলো মোট ৫৮২ কোটি শেয়ার ইস্যু করেছে, যার অভিহিত মূল্য ১০ টাকা করে। এ হিসাবে পরিশোধিত মূলধন দাঁড়ায় ৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ৪৪৩ কোটি শেয়ার, যার অভিহিত মূল্য প্রায় ৪ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। বাজারদরে এ শেয়ারের মূল্য ছিল মাত্র ১ হাজার ২২ কোটি টাকা।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, গভর্নরের বক্তব্য আন্তর্জাতিক প্রথা অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নেই। অনেক বিনিয়োগকারী এমন আর্থিক প্রতিবেদন দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা স্পন্সর ও নিরীক্ষকদের সহায়তায় বিভ্রান্তিকরভাবে প্রস্তুত হয়েছিল। সরকার চাইলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগকারীরাও দায় এড়াতে পারেন না। এসব ব্যাংকের দুরবস্থা অনেক আগে থেকেই জানা ছিল, তাদের বিক্রির সুযোগও ছিল।
সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি আসিফ খান বলেন, এটি কোনো ‘মার্জার’ নয়, বরং আমানতকারীদের সুরক্ষায় করদাতাদের অর্থে পরিচালিত একটি উদ্ধার (নধরষড়ঁঃ) প্রক্রিয়া। এই ব্যাংকগুলো কার্যত দেউলিয়া। তাদের সম্পদ দায়ের তুলনায় কম, ফলে আইন অনুযায়ী আগে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে। সরকার বর্তমানে আইএমএফ কর্মসূচির আওতায় থাকায় শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সামর্থ্যও নেই।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বাজারে শেয়ার সবচেয়ে বেশি মোট ১১৩ কোটি শেয়ার, যার নামমাত্র মূল্য ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। বাজারমূল্য ছিল মাত্র ২১৫ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১০০ কোটি শেয়ার নাম মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা, বাজার মূল্য ৩০১ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংকের ৯৭ কোটি শেয়ার ২৯৩ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৮৪ কোটি শেয়ার ১৪২ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের ৪৭ কোটি শেয়ার ৭১ কোটি টাকায় লেনদেন হচ্ছিল।
বিনিয়োগকারী মিজানুর রহমান বলেন, সরকারেরও কিছুটা দায় আছে। কারণ এসব ব্যাংকের আর্থিক দুরবস্থা অনেক আগেই জানা ছিল। তাই বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্চেন্ট ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, শেয়ার ও আমানত এক নয়। ব্যাংক দেউলিয়া হলে আগে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়, এরপর কর্মীদের বেতন ও বন্ডধারীদের পাওনা। ব্যাংকগুলোর সম্পদই যদি পর্যাপ্ত না থাকে, তাহলে শেয়ারহোল্ডাররা আইনি দিক থেকে কিছুই পাবেন না। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি ২০ হাজার কোটি টাকার পুনঃমূলধন তহবিল দেয়, সেটিও আমানতকারীদের জন্যই ব্যয় হবে, শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নয়।
বিএসইসি সূত্র জানায়, পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় বিএসইসিকে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়েছে। এ সংক্রান্ত কোনো কমিটিতে বিএসইসির প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি। ফলে একীভূতকরণের মাধ্যমে নতুন ব্যাংক গঠিত হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় তারা কোনো মতামত দিতে পারেনি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোর শেয়ারের বড় ধরনের নেগেটিভ ইক্যুয়িটির কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা না দেওয়া এবং ব্যাংকগুলোর শেয়ার শূন্য হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিএসইসির পক্ষ থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় পাঁচটি বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণ বিষয়ে আগের সিদ্ধান্তই ঘোষণা করা হয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিএসইসির কোনো সুপারিশই আমলে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, যেহেতু ব্যাংকগুলো অবসায়ন না করে নতুন একটি ব্যাংক গঠিত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছি। আশা করি এসব ব্যাংক পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত হওয়ার আগে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক রেজ্যুলেশনের ৭৭ ধারায় এসব ব্যাংকের দুর্দশার জন্য কারা দায়ী সে বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কোনো অবস্থাতেই এর জন্য দায়ী নন। সুতরাং তাদের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়ে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিএসইসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গঠিত নতুন ব্যাংকে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগান দেবে। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় কোনো কিছু করবে না, এটা কাম্য হতে পারে না।
জানা গেছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ২০৮ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে শেয়ার সংখ্যা রয়েছে ১২০ কোটি ৮১ লাখ। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশ ৬৫ শতাংশের বেশি। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে আরও ২৯ শতাংশ। মাত্র ৬ শতাংশ শেয়ার কোম্পানি উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৮৭ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে শেয়ার রয়েছে ৯৮ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার সংখ্যা প্রায় ৩২ শতাংশ। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৫৩ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে। উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের অংশ মাত্র ১৫ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে শেয়ার সংখ্যা ১০৩ কোটি ৬৩ লাখ। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা প্রায় ৩২ শতাংশ। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের অংশ ৫৪ শতাংশ।
এক্সিম ব্যাংকের ১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে শেয়ার সংখ্যা রয়েছে ১৪৪ কোটি ৭৬ লাখ। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা ৩৯ শতাংশ। আর প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ২৯ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা। কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে মাত্র ৩২ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বিপরীতে শেয়ার সংখ্যা ১১৪ কোটি ২ লাখ। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা ১৯ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মালিকানা ৬৯ শতাংশ। উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের মালিকানা মাত্র ১২ শতাংশ।

