শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না । ফলে সকলের মাঝে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিম্নমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন।

বিষয়টি যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাজারের ভারসাম্য ধরে রাখতে ইনভেষ্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) কয়েকটি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ছাড়া বাকিগুলো পুরোপুরি নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

পোর্টফলিও ম্যানেজারসহ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী বর্তমানে সাইডলাইনে থেকে বাজার পর্যবেক্ষণে বেশি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া, বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী। এছাড়া রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত অনেকে মার্জিন লোন নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পরিণতিতে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে না।

তবে পুঁজিবাজারের হঠাৎ এ দরপতকে সরলভাবে নিতে পারছেন না দক্ষ বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবি, পুঁজিবাজারের এ দরপতনের পেছনে আবারও কোনো কারসাজি চক্র সক্রিয়, নাকি নির্বাচন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি জামায়াত পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে চায় তা দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খতিয়ে দেখতে হবে। তা না হলে বিনিয়োগকারীরা আবারও বড় লোকসানের মুখে পড়বেন।

পুঁজিবাজার হঠাৎ দরপতন হওয়ার পেছনে প্রধানত চার কারণ বিদ্যমান বলে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ ও দেশ প্রতিক্ষণ ডটকমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ, দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এবং বড় ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথায় এ চারটি কারণ উঠে এসেছে।

প্রথমত, নির্বাচন সামনে রেখে পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কোনো কোনো মহল। তারা বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকতে বা বিনিয়োগ উঠিয়ে ফেলার জন্য গুজব ছড়াচ্ছে যে, সামনে শেয়ারের দাম আরও কমবে। এগুজবের সাথে ডিএসই বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজ জড়িত। এরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পুঁজিবাজার ইস্যুতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এ ব্যাপারে বিএসইসি’র সজাগ থাকা উচিত। তা না হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বিনিয়োগকারীরা।

দ্বিতীয়ত, সার্বিকভাবে দেশ উন্নয়নে দিকে এগিয়ে যাচেছ। গত কয়েক বছরে সব সূচকের উন্নতির সঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছ মোট জাতীয় আয়ও (জিএনআই)। তবে জিডিপির উন্নয়নের সঙ্গে সমানতালে এগোয়নি পুঁজিবাজার। অর্থনীতির আকার বাড়লেও অনেকটা পেছন পানে হাঁটছে ২৬ লাখের বেশি বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজার। অনেকে পুঁজিবাজার থেকে মুখও ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময় শেয়ারবাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার চেষ্টা করলে এই বিনিয়োগকারীরা ফিরে এসে কয়েক দিনের মধ্যে আবার হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এই আস্থার অভাবেই পুঁজিবাজার অস্থিরতার নেপথ্যে কারন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

তৃতীয়ত, সামনে নির্বাচন ইস্যুতে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী দু:চিন্তায় রয়েছেন। দেশের পরিস্থিতি কি হয়। মূলত দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় বাজারে সূচক ও লেনদেন কমেছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, এ মুহূর্তে দেশে কোনো হরতাল বা অবরোধ না থাকলে নির্বাচনী ইস্যুতে বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে চলে যাচ্ছে।

চতুর্থত, জুন ক্লোজিং কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুমে ইভেন্স টেক্সটাইল নো ডিভিডেন্ড ঘোষনার পর পুঁজিবাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। লভ্যাংশ ঘোষণার বড় মৌসুমেও পুঁজিবাজারের লেনদেন ও সূচকে মারাত্মক অধোগতি চলছে। অব্যাহত দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট চলছে। কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই বাজারের নেতিবাচক আচরণে বিস্মিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্মকর্তারাও। এমন পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক বাজার পতনের কারণ অনুসন্ধান ও সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সরকারের তিন সংস্থার দ্রুত সমন্বয় প্রয়োজন।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে হলে তারল্য প্রয়োজন। তারল্য সংকট দুর করতে হবে। বর্তমান বাজারে তারল্য সংকট বিরাজ করছে। পুঁজিবাজারে আইসিবির ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করলে কিছুটা হলে তারল্য সংকট দুর হবে। এছাড়া বর্তমান উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হলে পুঁজিবাজার উপকৃত হবে। এর সঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যরা চীনা কনসোর্টিয়াম থেকে পাওয়া অর্থও পুঁজিবাজারে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিনিয়োগ করলে বাজার আরো স্থিতিশীল হবে বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান-উর-রশিদ চৌধুরী বলেছেন, পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতনে নি:স্ব হয়ে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফান্ডামেন্টাল, অ্যানালাইসিস, বিনিয়োগ শিক্ষা কোনো কাজে আসছে না। সামগ্রিক পুঁজিবাজার ভালো না থাকলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে বাজারকে গতিশীল করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুদৃষ্টি কামনা করলেও তারা বাজারের স্বার্থে কাজ করছে না। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নয় বরং কতিপয় মহলকে বিশেষ সুবিধা দিতে বিএসইসি কাজ করছে বলে জানান তিনি।

আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হক বলেন, পুঁজিবাজারকে চাঙ্গা রাখতে নগদ অর্থের প্রবাহ দরকার। তারল্য সংকট কাটাতে বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আশা করি বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থের বেশির ভাগ অর্থই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হবে। এর প্রভাব অবশ্যই পুঁজিবাজারে পড়বে। এ জন্য বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য্য ধারন করতে হবে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তে পুঁজিবাজার ও মুদ্রাবাজারের মধ্যে দৃঢ় সেতু তৈরি হবে। আইসিবি পুঁজিবাজারে আরও বেশী কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, যা পুঁজিবাজারকে গতিশীল করবে। আর চুড়ান্ত বিচারে তা দেশের অর্থনীতিতেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ডিএসইর পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত দাবিগুলো বাস্তবায়ন না করায় পুঁজিবাজারে বারবার রক্তক্ষরণ ঘটছে। তাই এসব বিষয়ে বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাতে কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছি। বিএসইসি চেয়ারম্যান এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। তাছাড়া বেশকিছু বোকার্স, ডিলারস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের আচরণ আমাদের কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে আমরা কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছি। আমাদের পক্ষ থেকেও এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি চীনের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। শেয়ারহোল্ডার হিসাবে আমরা এখনও এ টাকা হাতে পাইনি। সরকার ক্যাপিটাল গেইনের ওপর পাঁচ শতাংশ কর ধার্য করেছে এবং শর্ত দিয়েছে পুঁজিবাজারে ওই টাকা তিন বছরে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে আমরা সবাই একমত হয়েছি। কিন্তু এ টাকা পেতে একটু দেরি হচ্ছে। আমি এনবিআরের উদ্দেশ্যে বলব তারা যত তাড়াতাড়ি আমাদের টাকা দেবে, আমরা তত তাড়াতাড়ি সেই টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারব। বর্তমানে পুঁজিবাজারে এ টাকা বিনিয়োগ করলে তারল্য সংকট কিছুটা কমবে এবং বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহী হবে।

পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক দরপতনে কিছু প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের আলোচনা হয়েছে। সাম্প্রতিক দরপতনের বিষয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। কোনো ধরনের যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই বাজারে দরপতন হচ্ছে। আমাদের সার্ভিল্যান্সের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি নিয়মিতই পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়, এমন কোনো কিছু পরিলক্ষিত হলে কমিশন সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেবে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারকে কার্যকর করতে কিংবা যথাযথভাবে গড়তে নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে। মৌল ভিত্তির কোম্পানি বাজারে এলে বিনিয়োগকারীও আকৃষ্ট হবে। গতিশীল ও কার্যকর বাজার গড়ে তুলতে কোম্পানির সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। যদিও একটি তালিকাভুক্তিতে অনেক সময় ও জটিলতা রয়েছে। বাজারে বহুজাতিক ও সরকারি কোম্পানি আনা খুব জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক উসমান ইমাম বলেন, ‘বাইরের কোনো কোনো দেশের পুঁজিবাজার জিডিপির চেয়েও বহুগুণ বেশি। আমাদের পশ্চাদ্গতির কারণ হচ্ছে সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসতে না পারা। বহুজাতিক কোম্পানিকে বুঝিয়ে কিংবা ব্যবসা পরিচালনায় শর্ত দিয়েই বাজারে আনতে হবে। কোনো দেশেই বহুজাতিক কোম্পানি সহজে তালিকাভুক্ত হয় না।

নিয়মনীতির মাধ্যমে কিংবা প্রণোদনা দিয়ে আনতে হয়। নিজেদের স্বার্থে প্রণোদনা দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারে আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ইকুয়িটিনির্ভর না হয়ে বন্ড কিংবা অন্যান্য পণ্যও আনতে হবে। জনগণকে বিনিয়োগমুখী করতে হলে বিভিন্নতা আনতে হবে।