শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি ন্যাশনাল ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিতে রয়েছেন। ব্যাংকটির নানামুখী অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি এবং লোকসানি শাখার কারণে অনেকটা ঝুঁকির মধ্যে সময় পার করছে প্রথম প্রজন্মের এ ব্যাংকটি। তিন হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপির খাতায় যার অবস্থান এখন দ্বিতীয়।

কেউ কেউ এমনও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, সহসা সংকটের উত্তরণ না ঘটলে এর পরিণতি ফারমার্স ব্যাংকের মতো হতে পারে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ন্যাশনাল ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নেই। এক বছর ধরে ব্যাংকটি চলছে ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়ে। এতে ব্যাহত হচ্ছে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রমও। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

page 1সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা আউটসোর্সিং নামের একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ অনুমোদন করে ন্যাশনাল ব্যাংক। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ করা হয়। তাদের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পথেই হাঁটছে ন্যাশনাল ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। যদিও বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২ থেকে ৫ শতাংশ।

কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ, যা ৩৯টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাদের মতে, বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৩ শতাংশ হওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। এভাবে চলতে থাকলে ন্যাশনাল ব্যাংকও একদিন সরকারি ব্যাংকের সারিতে নেমে আসবে। আবার কেউ বলছেন, ফারমার্স ব্যাংকের মতো একই পরিণতি হতে পারে।

এদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে এসে বড় মুনাফা করেছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারে কোম্পানিটির মুনাফা ১৬৯ শতাংশ বেড়ে ৪৩ পয়সা হয়েছে।
গত বছর একই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল ১৬ পয়সা। তবে নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) হিসাবে ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে। এসময়ে সমন্বিত হয়েছে ইপিএস হয়েছে ৮৮ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল এক ১ টাকা ৩ পয়সা।

তিন প্রান্তিক মিলে ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদমূল্য (এনএভি) ১৬ টাকা ৮১ পয়সা থেকে কমে ১৫ টাকা ৯৫ পয়সা হয়েছে। তবে কোম্পানির কার্যকরী নগদ অর্থপ্রবাহ (এনওসিএফপিএস) বেড়েছে। আগের একই সময়ের ঋণাত্মক ৩১ পয়সা থেকে ৩ টাকা ৬১ পয়সা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কয়েক বছর আগেও সেরা পাঁচটি ব্যাংকের একটি ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক। যখন থেকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের ৫ জন সদস্য এলো তখনই ব্যাংকটির অবনতি ঘটতে থাকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নোটিশ দিয়েছিল।

কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা আর কার্যকর হয়নি। তাদের কারণে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে। বিলটি পাস হলে বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবারের চারজন এবং টানা ৯ বছর পরিচালক থাকার সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে দেবে। মূলত উপর মহলের আশকারায় ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি বেড়ে ৩ হাজার ২৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ মাত্র ৯ মাসে ব্যাংকটির আড়াই গুণের বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১২৩ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৬১ কোটি টাকা। এতে মাত্র ৯ মাসেই ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৭৩৮ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৬ সাল শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসানি শাখা ছিল ৩৩টি। বিদায়ী বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির লোকসানি শাখা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬টিতে।

এ বিষয় জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঋণখেলাপি এবং প্রভিশন ঘাটতি দুটোই অস্বাভাবিক। এত স্বল্প সময়ে একটি ব্যাংকের এমন করুণ পরিণতি হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির ঋণের মান এবং বিতরণ প্রক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এর দায় পরিচালনা পর্ষদ এড়াতে পারে না।

সূত্র মতে, ব্যবস্থাপনায় পর্ষদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপে গত তিন বছরে ন্যাশনাল ব্যাংকের তিনজন এমডি পদত্যাগ করেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এএফএম শরিফুল ইসলাম পদত্যাগের পর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংকটির এমডি পদ শূন্য রয়েছে। তখন থেকেই ন্যাশনাল ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোশতাক আহমেদ। তাকে পূর্ণাঙ্গ এমডি করার প্রস্তাব দেয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা নাকচ করে দেয়। সে কারণে ব্যাংকটির এমডি পদ শূন্য রয়েছে।

অথচ ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর ১৫ ক ধারার উপধারা-২তে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ তিন মাসের অধিক সময়ের জন্য শূন্য রাখা যাবে না। একই ধারার উপধারা ৩ এ বলা হয়, তিন মাস সময়সীমার মধ্যে কোনো ব্যাংক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ পূরণ করা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কোম্পানির তদস্থলে প্রশাসক নিযুক্ত করতে পারবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এমডি নিয়োগের জন্য দীর্ঘদিন ন্যাশনাল ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ না থাকায় ব্যাংকটিতে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের তৎপরতায় তা থেমে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি ব্যাংকের এমডিকে যোগদানের প্রস্তাব দেয় ন্যাশনাল ব্যাংক। কিন্তু কেউই রাজি হয়নি।

এরপর চৌধুরী মোশতাক আহমেদকে এমডি পদে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়। কিন্তু এটিও ঝুলে যায়। কেউ কেউ বলছেন, মোশতাকের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন আপত্তি জানিয়েছে তখন বিকল্প ভাবা উচিত। তা না হলে এমডি ছাড়া ২০১৮ সালও কাটাতে হবে। তাতে ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।

সূত্র জানায়, চৌধুরী মোশতাক আহমেদ ন্যাশনাল ব্যাংকে যোগদানের আগে ফারমার্স ব্যাংকের এমডি ছিলেন। সে সময় ব্যাংকটিতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি সংঘটিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করা ও মিথ্যা তথ্য দেয়ায় চৌধুরী মোশতাককে জরিমানা করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে দন্ডপ্রাপ্ত একজন ব্যাংকারকে এমডি নিয়োগ দেয়া যায় কিনা, সে মতামত চেয়ে বিষয়টি আইনজীবীর কাছে পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সেখানে আটকে আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি চৌধুরী মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি। এরপর ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি। অভিযোগ আছে, তিনি দায় এড়াতে সব সময় মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন। এটি তার অপকৌশল। তবে গণমাধ্যমকে ফেস না করায় উত্থাপিত অভিযোগগুলো আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে ন্যাশনাল ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে সিকদার পরিবারের সদস্য রয়েছেন পাঁচজন। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সিকদার গ্রæপের কর্ণধার জয়নুল হক সিকদার। এছাড়া নীতিনির্ধারণী প্রায় সব পদই এ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক পদে রয়েছেন জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার। নির্বাহী কমিটি (ইসি) ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন জয়নুল হক সিকদারের কন্যা পারভীন হক সিকদার। এছাড়া পর্ষদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন চেয়ারম্যানের দুই পুত্র রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার।

অথচ বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে একই পরিবারের দু’জনের বেশি সদস্যের কোনো ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ নেই। এ সংশোধনীসহ ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে আইনটি পাস হলেও ন্যাশনাল ব্যাংকে এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। সুশাসনের ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় ২০১৪ সালেই ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয় জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এএসএম বুলবুল বলেন, ইতিমধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। চলতি বছরে আরও উন্নতি হবে। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত বলেছেন, আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আনলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে। দেশের ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। এ জন্যই এ খাতে বড় বড় অনিয়ম হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের সমস্যা দ্রæত দূর করা না গেলে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকে পড়বে। এ জন্য ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ এখনই ভেঙে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া দরকার। এভাবে ছয় মাস চলার পর পরিস্থিতির উন্নতি হলে ফের পরিচালকদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।’