পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হাতে থাকা শেয়ার বিক্রির ধুম পড়ছে। এর ফলে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ছে পুঁজিবাজারে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির ফলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। এছাড়া বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।

তেমনি দুই বিদেশী হত্যাকান্ডের পর থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা পুঁজি আমাদের দেশ থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। গত এক মাস ধরে অধিকাংশ বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তবে বিদেশী বিনিয়োগক্রাীদের শেয়ার বিক্রির ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে পুঁজিবাজারে। গত ৭ মাসের ৫ মাস তারা বাংলাদেশের শেয়ারবাজার থেকে যে পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, বিক্রি করে দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি।

শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এবারই প্রথম এক বছরে ৫ মাস বিদেশিরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার (শেয়ার ক্রয়ের থেকে বিক্রয় বেশি) করলো।  বছরটিতে এখনো তিন মাস বাকি রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ, এপ্রিল, মে, আগস্ট ও অক্টোবর এই ৫ মাসেই বিদেশিরা শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে।

এরমধ্যে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত টানা ৩ মাসে বিনিয়োগ উঠিয়ে নেওয়া হয় ১৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এরপর দুই মাস গ্যাপ দিয়ে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ তুলে নেওয়া হয়েছে ১৭৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। প্রথম ধাপে মার্চে ৩২ কোটি ২৯ লাখ টাকা, এপ্রিলে ৬৭ কোটি ১ লাখ টাকা ও মে মাসে ৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ তুলে নেয় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। আর শেষ দুই মাসের মধ্যে আগস্টে ১১৩ কোটি ৯৬ লাখ এবং সেপ্টেম্বরে ৬২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ তুলে নেওয়া হয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের আগে শেয়ারবাজার থেকে টানা ৩ মাস বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটে ২০১০ সালে। ওই বছরের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে টানা বিনিয়োগ তুলে নেয় বিদেশিরা। এরপর আর কখনো টানা তিন মাস বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেনি বিদেশিরা। তবে ২০১১ সালে দুই ধাপে ৩ বার বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটে।

অবশ্য ২০১১ সালের আগস্টের পর টানা ৪২ মাসে আর বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেনি বিদেশিরা। প্রতি মাসেই বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির তুলনায় ক্রয় ছিলো বেশি। তবে হঠাৎ করেই চলতি বছরের শেষ ৭ মাসের মধ্যে ৫ মাসই বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যার করা হলো।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী  বলেন, বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছে তাদের মধ্যে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের বিদেশি বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারের জন্য ক্ষতিকর। বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে দীর্ঘ মেয়াদি ভালো বিনিয়োগকারী প্রয়োজন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক রিসার্চ কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, দেশের বর্তমান সামষ্টিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে অবস্থানে আছে তাতে বিনিয়োগ প্রত্যাহার হওয়ার কোন কারণ নেই। সুতরাং বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের চিত্র দেখে বোঝা যাচ্ছে, তারা বাজার থেকে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রবণতা চালাচ্ছেন।

তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা গুটি কয়েক হাউজের মাধ্যমে লেনদেন করেন। দেখা যায় শেয়ার বিক্রির সময় তারা দলবেঁধে বিক্রি করেন। ফলে শেয়ারবাজারেও তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত কয়েক মাসের বাজার চিত্র দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাই স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের উচিত ভীত হয়ে লেনদেন না করে, সার্বিক তথ্য যাচাই করে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করা।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত টানা ৩ মাস বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার পর জুন ও জুলাই মাসে বড় অঙ্কের নতুন বিনিয়োগ করে বিদেশিরা। এরমধ্যে জুন মাসে ২০১০ সালের পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ’র (ডিএসই) মাধ্যমে বিদেশিদের লেনদেন ছিলো সর্বোচ্চ।

মাসটিতে বিদেশিদের মোট লেনদেন ছিলো ৯৬৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ ৫৩২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আর বিক্রির পরিমাণ ৪৩১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ নীট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১০১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

পরের মাস জুলাইতেও বিদেশিদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের নীট পজিশন দাঁড়ায় প্রায় শতকোটি টাকা। মাসটিতে ২৬৭ কোটি ৯ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রয় করে ১৮৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকার। অর্থাৎ জুলাইতে শেয়ারবাজারে নীট বিদেশি বিনিয়োগ আসে ৮৩ কোটি ২১ লাখ টাকা।

টানা দুই মাস বিনিয়োগ বাড়ানোর পরেই আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে আবার বিনিয়োগ তুলে নেওয়া হয়। এরমধ্যে আগস্টে ৩১৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার শেয়ার ক্রয়ের বিপরীতে বিদেশিরা বিক্রি করেন ৪৩১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার শেয়ার। আর সেপ্টেম্বরে ২৩০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ক্রয়ের বিপরীতে বিক্রয় দাঁড়ায় ২৯৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

এদিকে তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, মার্চ থেকে মে টানা তিন মাস বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আগে বছরের প্রথম দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিলো বেশ ইতিবাচক।

স্টাফ রিপোর্টার