শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসি থেকে গ্রাহকদের আমানতের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। যেসব ঋণ এখন খেলাপি হয়ে গেছে। যাতে আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় গ্রাহকদের আমানত ঝুঁকিতে পড়েছে। ফলে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসি ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে চরম আর্থিক চাপে পড়েছে। মাত্র এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বা প্রায় ১৯৯ শতাংশ।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৩১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৭৬ কোটি ১৭ লাখ টাকায়। ওই বছর ব্যাংকটি ৩০ হাজার ২ কোটি ৫১ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, যার মধ্যে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১৭.২৫ শতাংশ যা ব্যাংক খাতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। ২০২৩ সালে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৪৮৩ কোটি ১০ লাখ টাকা।

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়েছে ৫৪৪ কোটি ৩৬ লাখ ৮৭ হাজার ৫২৯ টাকা, যা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে ২০২৪ সালে ব্যাংকের নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৪ কোটি ৯৫ লাখ ৬৭ হাজার ১৩১ টাকা এবং শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ০.৫৮ টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকের ভেতরের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এসব ঋণ গ্রহণ করে বিদেশে পাচার করেছেন, যার প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগকারীদের ওপর। বর্তমানে ব্যাংকের শেয়ার দর অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে এসেছে। সোমবার ব্যাংকটির শেয়ার দর ৯ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।

জানা গেছে, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের শেয়ার ৬ মাসের বেশি সময় ধরে ফেসভ্যালু বা অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর ব্যাংকটির শেয়ার দর ছিল ১০ টাকা ২০ পয়সা। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর শেয়ারটির দর ফেসভ্যালুর নিচে নেমে ৯ টাকা ৯০ পয়সায় নামে। ৭ মাস পর এসে সোমবার ব্যাংকটির শেয়ার দাম সর্বশেষ ৯ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শেয়ারদরে। তাছাড়া প্রভিশন সংরক্ষণের পর নিট মুনাফা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এতে ২০২৪ সালে ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এসব কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মতিউল হাসাকে ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। মোবাইলে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলনি।

ডিএসইর তথ্য মতে, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২০২৩ সালে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। তার আগের বছর ১২ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। কিন্তু ব্যাংকটি এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি।

এদিকে, ব্যাংকটির প্রয়াত চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মো. আব্দুল জলিলের প্রভাবেই গত ১৫ বছর ধরে ব্যাংকটি সরকারের সুনজরে ছিল বলে মনে করেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। ওই বছরগুলোতে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পেলেও গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির প্রকৃত চিত্র প্রকাশ্যে আসে। এতে বিনিয়োগকারীসহ গ্রাহকদের বড় একটি অংশ ব্যাংকবিমুখ হতে থাকে। ফলে ‘চেষ্টা’ করলেও ফেসভ্যালুর উপরে দর উঠছে না।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাপক হারে। ব্যাংকের ভেতরের লোকজনই এসব ঋণ নিয়েছেন এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। এর জেরেই সমাপ্ত অর্থবছরে ‘নো ডিভিডেন্ড’ ঘোষণা করতে হয়েছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোম্পানিটির শেয়ার দর ফেসভ্যালুর নিচে অবস্থান করায় বিনিয়োগকারীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মোট শেয়ার সংখ্যা ১১০ কোটি ৬৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪৩৫টি। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৩৯ দশমিক ২৮ শতাংশ শেয়ার, উদ্যোক্তা-পরিচালকদের রয়েছে ৩৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার রয়েছে ০ দশমিক ৭২ শতাংশ।