শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানি বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা বেশির ভাগ ঋণে বড় ধরনের অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি গঠন করে ঋণের বড় অংশই বের করে নিয়েছে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। কাগুজে এসব কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের বেশির ভাগেরই খোঁজ মিলছে না এখন।

ফলে এসব ঋণ আদায়ও হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এর আগে ঋণ অনিয়মের এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংকের হল–মার্ক কেলেঙ্কারি ও সাবেক ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) এবং বহুল আলোচিত পি কে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে।

জানা গেছে, বিতরণ করা ঋণ আদায় না হলেও ইউনিয়ন ব্যাংক এসব ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত ঋণ বিতরণ করেছে, তার সিংহভাগই খেলাপি বা অনিয়মের ঋণে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় এসব অনিয়ম ও করণীয় বিষয়ে ব্যাংকটির সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পর গত ২৭ এপ্রিল ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ নিয়ে একটি চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ব্যাংকটিকে এসব ঋণ সমন্বয়ে সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। প্রতি ত্রৈমাসিকে ঋণ আদায়ের অগ্রগতি জানাতে বলা হয়েছে।’ একসঙ্গে এই বিপুল পরিমাণ ঋণকে খেলাপি করা হলে তাতে পুরো আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়বে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ওই চিঠিতে এখনই পুরো ঋণকে খেলাপি না করে ধাপে ধাপে ঋণ সমন্বয় ও নিয়মিত করার জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সমন্বয় বা নিয়মিত করতে না পারলে এসব ঋণকে খেলাপি করার নির্দেশ দেওয়া হয় চিঠিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত পরিদর্শক দল চলতি বছরের শুরুতে ইউনিয়ন ব্যাংক পরিদর্শনে গিয়ে বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের এই তথ্য উদ্‌ঘাটন করে। এরপর ব্যাংকটির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একাধিক সভা হয়। তার ভিত্তিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখার ভল্টে ১৯ কোটি টাকার গরমিল পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে অজ্ঞাত কারণে ওই ঘটনায় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কোনো সংস্থা। ওই ঘটনার পর ব্যাংকটি পরিদর্শনে গিয়ে ঋণ অনিয়মের আরও নানা তথ্য খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বের করতে অসংখ্য কাগুজে কোম্পানি গঠন করেছিলেন। তবে সেসব কোম্পানি যৌথ মূলধন ও কোম্পানিসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) নিবন্ধিত ছিল। কিন্তু ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে যেসব কোম্পানির নামে ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছে, সেসব কোম্পানির অস্তিত্ব বলতে শুধু ট্রেড লাইসেন্স। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগেরই কোনো অস্তিত্ব নেই।

২০২১ সাল শেষে ইউনিয়ন ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বিতরণ করা এ ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। অথচ গত বছর শেষে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ৯ বছর আগে কার্যক্রম শুরু করা ব্যাংকটি এখন ইসলামি ধারার ব্যাংক। যাত্রার শুরুতে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ব্যাংকটি পরিদর্শনে গিয়ে জানতে পারেন, রাজধানীর পান্থপথ, গুলশান, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, খাতুনগঞ্জসহ প্রায় ৪০টি শাখার মাধ্যমে অর্থ বের করে নেওয়া হয়। এসব ঋণের যথাযথ নথিপত্রও ব্যাংকের কাছে নেই। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। তাই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এসব ঋণ আদায় হলে তার প্রমাণসহ বিবরণী তিন মাস পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, বস্তুগত মাপকাঠিতে শ্রেণীকরণযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা এবং গুণগত মাপকাঠিতে শ্রেণীকরণযোগ্য ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৮৯। এর মধ্যে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ২৫ শতাংশ হিসাবে ৪ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩৫ শতাংশ হিসাবে ৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা এবং বাকি ৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা বা ৪০ শতাংশ ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সমন্বয় বা নিয়মিত করতে হবে।

বস্তুগত ও গুণগত মাপকাঠিতে শ্রেণীকরণযোগ্য ঋণের অর্থ কী জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক সময় ব্যাংক পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ঋণের জামানত ও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই, যথাযথ নথিপত্রও নেই। আবার অনেক সময় এক কাজের জন্য ঋণ নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়। ঋণ নিয়মিত থাকলেও এসব ঋণ বড় ঝুঁকিতে পড়ে। তখন বস্তুগত ও গুণগত মাপকাঠিতে শ্রেণীকরণ করতে বলা হয়।’

যেভাবে চলছে ব্যাংকটি: ইউনিয়ন ব্যাংকের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির তহবিল খরচ ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ। ফলে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ সুদে আমানত এনে ব্যাংকটি কীভাবে মুনাফা করছে—এটাও বড় প্রশ্ন। কারণ, ব্যাংকটির যে সুদ আয় হয়, তার বড় অংশ আমানত সংগ্রহে খরচ হয়ে যায়।

এরপরও ব্যাংকটি ২০২১ সালে ৮৭ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। ২০২০ সালের মুনাফা ছিল ৯৮ কোটি টাকা। আর এই মুনাফা দেখিয়ে ইউনিয়ন ব্যাংক প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ৪২৮ কোটি উত্তোলন করেছে। গত জানুয়ারিতে ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তও হয়।

ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের ঋণ দেওয়ার কোনো লক্ষ্য নেই। শুধু আমানত এনে দিলেই পদোন্নতি ও বেতন বাড়ে। আর যেসব শাখা ব্যবস্থাপক বেনামি ঋণ দিতে পেরেছেন, তাঁরা সহজেই পদোন্নতি পেয়েছেন।

২০২১ সালে ইউনিয়ন ব্যাংকের আমানত ছিল ২০ হাজার ২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের আমানত প্রায় ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আর বিভিন্ন ব্যাংকের আমানত ৩ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর মধ্যে শুধু ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের আমানত দুই হাজার ২৯০ কোটি টাকা ও সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকের ৩৭৮ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক এসব আমানত ফেরত দিচ্ছে না, দফায় দফায় মেয়াদ বাড়াচ্ছে।

২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ১৯ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকায় ৮ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা ও চট্টগ্রামে ৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯৪ শতাংশই গেছে এ দুই শহরে। যদিও সারা দেশে সেবা দিতে গত বছর শেষে ব্যাংকটির শাখা বেড়ে হয়েছে ১০৪টি।

ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসানুল আলম ব্যাংকটির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১–এ লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির চাপ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের নিকট প্রধান সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতে উচ্চ অনাদায়ি ঋণও একটি বড় উদ্বেগের কারণ।’

সার্বিক বিষয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘একজন ব্যক্তির হাতে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকলে এমন বিপর্যয় হওয়া অসম্ভব কিছু না। আসলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের কোনো সদিচ্ছা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ জন্য এই খাতে যেকোনো সময় বড় বিপদ দেখা দেবে। তাঁর ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।’