শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটে অবশেষে হতাশা কাটিয়ে স্বস্তিতে পুঁজিবাজারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল প্রদানের খবরে ৫ দিনের টানা পতনের পর গতকাল থেকে ঘুরে দাড়িয়েছে পুঁজিবাজার। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর উদ্যোগের ফলে নতুন করে আস্থা ফিরতে শুরু করছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে।

তেমনি পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া বিশেষ তহবিল বাজারে তারল্য এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। তারা এই তহবিলের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং গভর্নর ফজলে কবির সহ পুঁজিবাজারের নীতি নির্ধারকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজার ইস্যুতে সরকারের ওপর মহল উদ্যোগ নেয়ায় বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা বেড়েছে। স্টেকহোল্ডারদের একটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরেই পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের দাবি জানাচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে শেয়ারবাজার উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে তহবিল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসছিল না। এখন তহবিল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসায় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পাাশপাশি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগমুখী হলে অচিরেই সূচক ৬ হাজার দেখা যাবে।

তেমনি লেনদেন হাজার কোটির উপরে যাবে। এদিকে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ তহবিল ঘোষণা করে। এ তহবিলের আওতায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিটি তফসিলি ব্যাংক ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ সুবিধা পাবে। এ তহবিল তারা নিজেরা গঠন করতে পারবে অথবা ৫ শতাংশ সুদে বিশেষ রেপোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে নিতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগের ফলে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ তারল্য সহায়তার অংশ হিসেবে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন ও এর বিনিয়োগ নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সোমবার এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার সকল তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সার্কুলার অনুযায়ী, প্রত্যেকটি তফসিলি ব্যাংককে ২০০ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে।

সে হিসেবে মোট ৫৯টি তফসিলি ব্যাংককে ১১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা দেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ শতাংশ সুদে এই ঋণ তহবিল দিবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ৭ শতাংশ সুদ হারে ঋণ হিসেবে দিতে পারবে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, ব্যাংকসমূহ ১৩ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত যে কোন কার্যদিবসে রেপোর মাধ্যমে বর্ণিত ২০০ কোটি টাকার সীমার মধ্যে যে কোন অংকের তহবিল বাংলাদেশ ব্যাংক হতে সংগ্রহ করতে পারবে। রেপোর সুদের হার ৫ শতাংশ নির্ধারিত থাকবে এবং কোন প্রকার অকশনের প্রয়োজন হবে না।

এ বিষয় বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজার উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনা প্রয়োজন ছিল। সেই লক্ষ্যে বাজারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলে কিছু সুপারিশ ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজার উন্নয়নে একটি তহবিল গঠন করেছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। পুঁজিবাজারের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজিবাজার উন্নয়নে এই তহবিলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি এই তহবিলকে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমার বাইরেও রাখা হয়েছে। এই তহবিল গঠনে ব্যাংকের কোনো প্রভিশন রাখতে হবে না। ব্যাংক এ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। যাতে দীর্ঘ মেয়াদে পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের গতিশীল করার পক্ষে সহায়ক। পুঁজিবাজারের অগ্রযাত্রায় এই সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রাখবে।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বিশেষ তহবিলের বিষয়টি পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক একটি বিষয়। এই তহবিলের মধ্য দিয়ে বাজারের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বলেন, বিশেষ তহবিল পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে সহায়তা করবে। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের জন্য বাড়তি সুবিধা পাবে। যদি তারা বিনিয়োগ করার বিষয়টিকে আকর্ষণীয় মনে করে তাহলে তারা এই সুযোগকে সহজেই কাজে লাগাতে পারবে।

মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বিশেষ তহবিলের বিষয়টি সরকারের নৈতিক অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে। তারা যে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সব সময় আন্তরিক তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এতে। এই বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে তারল্য একটি সঙ্কট। কিন্তু কখনো কখনো আস্থার সঙ্কট তারল্য সঙ্কটের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে বাজারে। বিশেষ তহবিল একইসঙ্গে তারল্য ও আস্থা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। তবে আস্থা বাড়াতে আগামীতে আরও কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি বলেন, বিশেষ তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভালো শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের বিষয়টিকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বিনিয়োগযোগ্য শেয়ারের বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, খুবই সুচিন্তিতভাবে এই তহবিলের গঠনের বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে অনেকগুলো কোম্পানির শেয়ারের দাম বিনিয়োগের জন্য খুবই যৌক্তিক পর্যায়ে আছে।

তাই এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করলে ব্যক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সবারই লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। মিনহাজ মান্নান ইমন তারল্য বাড়ানোর পাশাপাশি বাজারে ভাল শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। বাজারের টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে ভাল শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে, যেসব শেয়ার বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগকারীদেরকেও বাজারে টেনে আনবে।

এ বিষয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক মোঃ রকিবুর রহমান বলেন, বিশেষ তহবিলের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। বিশেষ তহবিল গঠনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাজার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া উদ্যোগের বাস্তবায়ন আরও এক ধাপ এগিয়েছে। এটি বাজারের উন্নয়নে খুবই তাৎপর্যময় একটি বিষয়। এই তহবিল বাজারে তারল্য বাড়াবে। অন্যদিকে ভালো শেয়ারে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে। কারণ তহবিলের অর্থ বিনিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংক সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, এই তহবিলের আগে অর্থমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কিছু কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে পুঁজিবাজারের জন্য একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, অর্থমন্ত্রী যে কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার কথা বলেছেন, তার বাইরেও অনেকগুলো লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এগুলোকেও বাজারে নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে। তিনি সরকারকে একটি হোল্ডিং কোম্পানি গঠন করে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে থাকা সরকারী শেয়ারগুলোর মালিকানা ওই কোম্পানিতে স্থানান্তর এবং পরবর্তীতে ওই কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার পরামর্শ দেন।

ডিএসইর সাবেক এই প্রেসিডেন্ট পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাগিদ দিয়ে বলেন, বিশেষ তহবিল গঠনের মধ্য দিয়ে বাজারের তারল্য সঙ্কট কিছুটা লাঘব হবে আশা করা যায়। এখন দরকার পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোরালো উদ্যোগ নেওয়া। আইপিওতে আসা কোম্পানি, তার অডিটর ও ইস্যু ম্যানেজারকে আরও বেশি দায়বদ্ধ করা।

কোনো আইপিওতে মিথ্যা তথ্য দিলেও, ব্যালেন্সশিটে কারসাজি করলে কোম্পানির পর্ষদ সদস্য ও কর্মকর্তা এবং নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি সেকেন্ডারি বাজারে কোনো কারসাজি হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান, এমনকি ডিএসইতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।

এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম  দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজার ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারের গতিশীল করার পাশাপাশি লেনদেন বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে চিত্র পাল্টে যাবে।

পুঁজিবাজারের অগ্রযাত্রায় এই সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, সরকারের ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্ত হলে তাতে বাজারের ভালো শেয়ারের ঘাটতি কিছুটা হলেও দূর হবে। এতে উভয় দিক থেকে সরকার লাভবান হবে। একদিকে শেয়ার বিক্রি করে সরকার টাকা পাবে, অন্যদিকে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে সহায়তা করবে।

তিনি আরো বলেণ , পুঁজিবাজারে আনার আগে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক প্রতিবেদন ভালোভাবে নিরীক্ষা করানো দরকার, যাতে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্বচ্ছতার কোনো ঘাটতি না থাকে। ব্যাংকের শেয়ার বাজারে আনার আগে ব্যাংক খাতের বর্তমান দুরবস্থা দূর করতে হবে, তা না হলে ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না বিনিয়োগকারীরা।