dse-cseআমিনুল ইসলাম, ঢাকা: সপ্তাহজুড়ে ধারাবাহিক দরপতনে  অস্থির ছিল দেশের পুঁজিবাজার। গেল সপ্তাহে লেনদেন হওয়া পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে সূচক একদিন সামান্য ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও দরপতন হয়েছে বাকি চারদিন। এসময় সব ধরণের মূল্য সূচকের পাশাপাশি কমেছে লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ শেয়ারের দর। একই সঙ্গে কমেছে পিই রেশিও ও বাজার মূলধন।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মুনাফা অনেকটা কমতে দেখা গেছে। এছাড়াও অন্যান্য কোম্পানিগুলো মুনাফার দিকে তাকিয়ে আছে বিনিয়োগকারীরা। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিযোগকারীরা বাজারে অনেকটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে। আর এসব করণে আস্থাহীনতায় বিনিয়োগকারীরা নতুন করে শেয়ার কিনছে না। যাদের বাজারে বিনিয়োগ রয়েছে তারাও তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে। সব মিলিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলছেন, বর্তমান সময়ে বাজার যে অবস্থায় থাকার কথা তা নেই। প্রতিদিনই কমছে শেয়ারের দর। এমন অবস্থায় বাজারের প্রকৃত অবস্থা অনুসন্ধানের দাবি বিনিয়োগকারীদের। গেল সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে একদিন বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখি থাকলেও বাকি চারদিন গেছে পতন ধারায়। প্রতিটি মূল্য সূচকের পাশাপাশি এ সময়ে দর কমেছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের। একই সঙ্গে সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। এভাবে দরপতনে পুঁজি হারিয়ে পথে বসছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জাতীয় ঐক্যের সাধারণ সম্পাদব আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, পাঁচ কার্যদিবস মধ্যে চার কার্যদিবস বাজারে পতন অব্যাহত ছিল। শেষ কার্যদিবসে সুচকের উধ্বমুখী দেখা দিলেও তা স্থায়ী বাজারের লক্ষন নয়। কিন্তু এমন অবস্থাতেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে কোনো কারণ প্রকাশ করা হয়নি বা কেন বাজারে পতন অব্যাহত এটি চিহ্নিত করতে পারেনি। মূলত বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীরা যেমন আস্থা হারাচ্ছে ঠিক তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির প্রতিও বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই।

নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা উত্তোলন করলেও নির্দিষ্ট সময় পরে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারে না। এতেই বলা চলে বাজারে কি মানের কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে। বিএসইসিকে আরও যাচাই-বাছাই করে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত এবং বাজার থেকে উত্তোলনকৃত অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটিও তদারকি করা প্রয়োজন।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে অনেক নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে সেই হারে তারল্য প্রবাহ বাড়েনি। অন্য দিকে লেনদেনের মূল শক্তি টাকা ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আশ্বাসের পরও ঝুলে আছে পুঁজিবাজারে ব্যাংক ঋণ সমন্বয়ের সময়সীমা। ফলে সীমাবদ্ধতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারছেন না। একই সঙ্গে সমাপ্ত বছরে কোম্পানিগুলো আশানুরূপ মুনাফা দেয়নি। এসব কারণে বিনিয়োগ উপযোগী সময়েও সৃষ্টি হয়েছে আস্থাহীনতা। আর ধারাবাহিক দরপতনে পথে বসছেন বিনিয়োগকারীরা।

সাপ্তাহিক বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গেল সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার লেনদেন শুরুতে বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৩ কোটি ৯২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা; যা সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন শেষে নেমে আসে ৩ লাখ ১০ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন হারিয়েছে ৬ হাজার ৫১৭ কোটি ৭৭ লাখ ৯১ হাজার টাকা বা ২ দশমিক ০৬ শতাংশ।

গেল সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২৪৩ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার ৯১৪ টাকার শেয়ার; যা এর আগের সপ্তাহের তুলনায় ২৫৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বা ১৩ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি। আগের সপ্তাহে (চার দিনে) ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৯৮৪ কোটি ৮৬ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮৬ টাকার শেয়ার। গত সপ্তাহে ডিএসইতে টার্নওভারের পরিমাণও কমেছে। প্রতিদিন গড়ে টার্নওভার দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকায়, আগের সপ্তাহে যা ছিল ৪৯৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে টার্নওভার কমেছে ৪৮ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

সপ্তাহ শেষে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৯৪ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ০৭ শতাংশ, ডিএস ৩০ সূচক কমেছে ৩৪ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এছাড়া শরীয়াহ বা ডিএসইএস সূচক কমেছে ২৮ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

গেল সপ্তাহে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত মোট ৩৩০টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৭২টির, কমেছে ২৩১টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৪টির। আর লেনদেন হয়নি তিনটি কোম্পানির শেয়ার। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারের সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ২ দশমিক ০৬ শতাংশ কমে ১৪ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, বাজারে তারল্য ও আস্থা দুটিরই সঙ্কট রয়েছে। এছাড়া কোম্পনিগুলো আশানুরূপ মুনাফা দিচ্ছে না। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে ব্যাংক ঋণ সমন্বয়ের সময়সীমা (সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট) আশ্বাসের মধ্যে ঝুলে আছে।

এটা বাড়ালে পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক হবে। এতে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার লোকসান থেকে মুক্তি পাবেন বিনিয়োগকারীরা। এমন উদ্যোগ মন্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।

পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে অর্থের যোগান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বাজার সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্য ভেবে-চিন্তে দেয়া উচিৎ বলে মনে করেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি সায়েদুর রহমান।

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ইফতেখার-উজ-জামান বলেন, শেয়ারবাজারের সূচক ওঠানামা স্বাভাবিক নিয়ম। বর্তমানে পুঁজিবাজার বিনিয়োগ উপযোগী বাজার। শেয়ারবাজারের সূচকের গতি দেখে অর্থাৎ উত্থান-পতনে আতঙ্কিত না হয়ে শেয়ার কেনাবেচা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, গুজবে আতঙ্কিত না হয়ে জেনে-বুঝে ভালো কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলে সূচক কমে গেলেও ব্যবসা কমে যাবে না।