শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: ব্যাংক খাতকে ‘অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড’ বা চালিকা শক্তি বলা হয়ে থাকে। এই খাতের ভালো অবস্থা কিংবা মন্দ অবস্থা দুটোরই প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর পড়ে বলে উদ্বেগও থাকে। বাংলাদেশের এই ব্যাংক খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে উদ্বেগ। আর এই উদ্বেগকে নতুন করে আরও ঘনীভূত করেছে ব্যাংকের একীভূতকরণ (মার্জার)। মুলত আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে চলছে ব্যাপক অস্থিরতা।

ব্যাংক একীভূত হলে আমানতের টাকা নিরাপদে থাকবে কিনা তা নিয়ে আমানতকারীদের মধ্যে চলছে তুমুল আলোচনা। এছাড়া ব্যাংকগুলোর আগের মত লভ্যাংশ দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চিয়তা দেখা দিছে শেয়ারহোল্ডার মাঝে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ‘নিরাপদ আমানতের’ বুলি ছাড়লেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আমানতকারীদের মধ্যে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দুটি ব্যাংক একীভূত হলেও ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের অর্থ সম্পূর্ণ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। তবে আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এজন্য প্রকাশিত দুর্বল ব্যাংকের পাশাপাশি ভালো ব্যাংকগুলো থেকেও অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

এদিকে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংক এবং ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংকের একীভূত হওয়ার খবর প্রকাশের পর থেকে ব্যাংক দুটির বিভিন্ন শাখায় গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন বেড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খারাপ ও ভালো উভয় ব্যাংক থেকেই আমানত তুলে নিতে পারেন আমানতকারীরা। আমানতকারীদের টাকা যেন খোয়া না যায়, তা বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আমানতকারী, ব্যাংকার, পরিচালক ও স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকের একীভূতকরণ মার্জারকে আর্থিকখাত সংশ্লিষ্টরা শুরুতে সাধুবাদ জানালেও পরবর্তীতে বিষয়টি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অযৌক্তিক ও বৈষম্য হিসেবে দেখছেন। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ ও অসৎ ব্যাংক মালিকদের রক্ষায় দেশে ব্যাংকিং সেক্টরকে অস্থিতিশীল করতে দুরভিসন্ধিমূলক ভাবে এই মার্জারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি একীভূত করার বিষয়টিকে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপিয়ে দেওয়া বা নির্দিষ্ট ব্যাংককে টার্গেট করে নিজস্ব সিদ্ধান্ত হিসেবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন পক্ষ থেকে নানা আপত্তিও উঠতে শুরু করেছে।

এছাড়া ব্যাংক পাড়া ও দেশের অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে ‘মার্জার ইফেক্ট’। ব্যাংকের আমানতকারী ও গ্রাহকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। ব্যাংক কর্মকর্তারাও এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ব্যাংকখাতকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ এবং কোন কোন ব্যাংক প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছে।

অথচ দীর্ঘদিন থেকে আলোচনায় থাকা ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো বিশেষ করে লুটপাটে জর্জরিত একটি বিতর্কিত শিল্প গোষ্ঠীর হাতে থাকা ব্যাংকগুলোকে মার্জার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আলোচনায় ছিল ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকসহ ওই গ্রুপের আওতাধীন অন্যান্য একাধিক ব্যাংকের নাম। অথচ ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয় সামনে আসলে দেখা যায় এসব ব্যাংকের নামই নেই।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে মূল দায়িত্ব পড়েছে সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বর্তমান নীতি উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাছের-এর উপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত কয়েক বছরে বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে তার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি তার চাকরির বয়স ৬২ শেষ হওয়ার পরও উপদেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রেখে দেয়াকে অনেকে ভিন্ন চোখে দেখছেন।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে ভুল পরামর্শ দিয়ে সুস্থ ব্যাংককে অসুস্থ করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে ব্যাংক একীভূতকরণের এই চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তে তার একক হাত রয়েছে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর তাই ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করতে চাইছে তাদের বেশির ভাগই একীভূত হতে চাচ্ছে না। একীভূতকরণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছে ব্যাংক একীভূত হলেও আমানত নিরাপদ থাকবে।

এদিকে তড়িঘড়ি করে ব্যাংক একীভূত করার প্রতিবাদ জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, তড়িঘড়ি ও জোরপূর্বক একীভূতকরণ ব্যাংকিং খাতে অব্যাহত দায়মুক্তির নতুন মুখোশ। ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগের বাস্তবায়ন স্থগিত রাখারও আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।

এক বিবৃতিতে টিআইবি বলেছে, স্বেচ্ছাচারীভাবে চাপিয়ে দেওয়া কয়েকটি ব্যাংক একীভূতকরণের ঘোষণা এবং এ প্রক্রিয়ায় থাকা ভালো ব্যাংকগুলোর অস্বস্তি, একীভূত হতে কোনো কোনো দুর্বল ব্যাংকের অনীহা, সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে শঙ্কা, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা গভীরতর করেছে, যা একীভূতকরণের পুরো প্রক্রিয়াটিকে শুরুর আগেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।