শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: নেতৃত্বের দুর্বলতায় একসময়কার ভালো মানের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন কাপিটাল লিমিটেড টানা লোকসানের মুখে। কোম্পানিটির ভবিষ্যত নিয়ে বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন অন্ধকারে। টানা চার বছর ধরেই একটানা লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ধারাবাহিকভাবে কমছে ঋণ, আমানত ও পরিচালন আয়।

এমনকি দৈনন্দিন অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে ঋণ করে। এসব মুলে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে ডুবতে বসেছে আর্থিক খাতের কোম্পানি ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড। ঋণের নামে বের করে নেয়া অর্থ ফিরছে না কোম্পানিটিতে। এখন আমানতকারীদের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না কোম্পানিটি।

নেতিবাচক দক্ষতায় আমানতকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। গত চার বছর ধরেই কমছে প্রতিষ্ঠানটির আমানতের পরিমাণ। একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে বিনিয়োগ ও সুদ আয়। ফলে সার্বিকভাবে কমে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালন মুনাফা পর্যন্ত।

এছাড়া ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড সর্বশেষ চার বছরেরও বেশি সময় ধরে লোকসানে রয়েছে। সমাপ্ত অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করছে। এমনকি গত হিসাব বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি লোকসান গুনতে হয়েছে কোম্পানিটিকে। মূলত কোম্পানির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিনদিন বড় হওয়ায় এ লোকসানের বোঝাও বাড়ছে। মৃুলত চৌধুরী মনজুর লিয়াকতের দায়িত্ব পালনকালে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের লোকসান হয়েছে ১৭৪ কোটি টাকার বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় সব সূচকেই শক্ত অবস্থানে ছিল ইউনিয়ন ক্যাপিটাল। প্রতিবছর ভালো মুনাফা করেছে। একইসঙ্গে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ডও দিয়েছে। এরপর ২০১৯ সালে চৌধুরী মনজুর লিয়াকত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও’র দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ডুবতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে সব আর্থিক সূচকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা নীতি ছাড়ের সুযোগে করোনা মহামারির মধ্যে যখন সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভালো অবস্থানে উঠে এসেছে, তখনও মনজুর লিয়াকতের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি, বরং আরও অবনতি হয়েছে। এর পর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও গোলাম সাব্বির দায়িত্ব নেওয়ার পর ও কোম্পানিটির অবস্থা আরো অবনতির দিকে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ২১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। পরের বছর মুনাফা করে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালেও ৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা মুনাফা করে। কিন্তু পরের বছরে এসেই প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো লোকসানে চলে আসে এবং রীতিমতো ধস নামে। ওই বছর ইউনিয়ন ক্যাপিটাল প্রায় ১০৬ কোটি টাকা লোকসান করে। এর পরের বছরও থেকে যায় লোকসানের বৃত্তে।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের শুরুতে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চলতি দায়িত্ব পান চৌধুরী মনজুর লিয়াকত। এরপর ওই বছরের অক্টোবরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। আর ২০১৯ সাল থেকেই অধঃপতনে যেতে থাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।

ইউনিয়ন ক্যাপিটালের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মূলত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মনজুর লিয়াকতের অদক্ষতার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি তলানিতে নেমেছে। এতে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের আমানতকারীরা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।

ফলে গত টানা চার বছর ধওে লভ্যাংশ বঞ্চিত হচ্ছে ইউনিয়ন ক্যাপিটালের শেয়ারহোল্ডারা। এদিকে শেয়ারহোল্ডার ইকুইটি ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বিতরণ করা ঋণের সর্বনিন্ম ৪২ থেকে সর্বোচ্চ ৯৬ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে কোম্পানিটি ১৫ কোটি ৪৮ লাখ ১ হাজার টাকা মুনাফা করে ঐ বছর .৯৯ পয়সা ইপিএস ঘোষণা করে। ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোম্পানিটি ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করা হয়েছিল। স্টক ডিভিডেন্ডের নামে বিনিয়োগকারীদের কাগজ ধরিয়ে দিচ্ছে।

২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটির ৯ কোটি ২৩ লাখ ৯ হাজার টাকা মুনাফা করে ঐ বছর .৫৬ পয়সা ইপিএস ঘোষণা করে। ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য কোম্পানিটি ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করা হয়েছিল।

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কোম্পানিটির ১০৫ কোটি ৭৩ লাখ ৯ হাজার টাকা লোকসান করে ঐ বছর মাইনাস ৬.১৩ পয়সা ইপিএস ঘোষণা করে। ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঐ বছর কোন লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি। মুলত খেলাপি ঋণের কারণে কোম্পানিটি প্রথম বড় লোকসানের মুখে পড়ে।

২০২০-২০২১ অর্থবছরে কোম্পানিটির লোকসান একটু কমলেও ৫৩ কোটি ২৩ লাখ ৭ হাজার টাকা লোকসান করে ঐ বছর মাইনাস ৩.০৮ পয়সা ইপিএস ঘোষণা করে। ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঐ বছর নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে।

২০২১-২০২২ অর্থবছরে কোম্পানিটির লোকসানের পরিমান আরো বাড়ছে ঐ বছর ১৩৮ কোটি ৫৫ লাখ ৯ হাজার টাকা লোকসান করে মাইনাস ৮.০৩ পয়সা ইপিএস ঘোষণা করে। ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে।

লোকসান বাড়ার কারণ হিসাবে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আলোচ্য সময়ে তাদের সুদ বাবদ আয় অনেক কমে গেছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ায় তাদের অতিরিক্ত প্রভিশন সংগ্রহ করতে হয়েছে। এসব কারণে আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটিকে বড় অংকের লোকসান গুনতে হয়েছে।

খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ না হলে নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই সবকিছুর আগে কঠোরহস্তে প্রভাবশালীদের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এ খাত বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিশ্চয় প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক যোগসাজশে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তা না হলে এমন করুণ পরিস্থিতি হতো না। এছাড়া পরিচালক এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনারও দায় আছে। সার্বিকভাবে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংককে এখনই বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সূত্র: দেশ প্রতিক্ষণ