শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে আসার প্রক্রিয়ায় থাকা ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠান নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার বরাদ্দে কারসাজির অভিযোগ করেছেন আইপিও আবেদনকারীরা। কয়েকটি ফেসবুক গ্রুপে আইপিও আবেদনকারীরা অভিযোগ করেছেন, কিছু অসাদু ব্রোকারেজ হাউস আইপিও আবেদনকারীদের বিও হিসাবে ৫০ হাজার না থাকলেও কারসাজি করে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের আইপিওতে তাদের আবেদন প্রেরণ করেছেন। ফলে কোম্পানিটিতে রেকর্ড পরিমাণে আইপিও আবেদন পড়েছে।

তাদের অভিযোগ, এতে যাদের বিও হিসাবে ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ নেই, তারা অযোগ্য হয়েও আবেদন করেছেন এবং আইপিও শেয়ারও পেয়েছেন। বিপরীতে যারা বিও হিসাবে সত্যিকারভাবে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ রেখে আবেদন করেছেন, তারা আইপিও শেয়ার কম পেয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আবু বকর সিদ্দিক নামে এক আইপিও আবেদনকারী কালবেলাকে বলেন, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসে বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের আবেদন পড়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪২৮টি। স্টক এক্সচেঞ্জ এবং বিএসইসির কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ব্রোকার হাউসের কর্মকর্তারা আইপিও আবেদনে কারসাজি করছেন। প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের এত আবেদন জমা হতেই পারে না।

বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেছেন, ব্রোকার হাউসগুলো বিনিয়োগকারীদের বন্ধ কিংবা সাসপেন্ড হওয়া বিওতে আইপিও এপ্লাই করেছে এবং সিরিয়াল ট্রেডিং করেছে। যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত তা সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানান তারা।

ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত এমডি সাইফুর রহমান মজুমদার এই বিষয়ে আইপিও শেয়ার বরাদ্দের আগের দিন শনিবার বলেছিলেন, নাভানা ফার্মানিউটিক্যালসের আইপিও বরাদ্দের তথ্যই এখনো প্রকাশ হয়নি। সুতরাং কারসাজি হবে কীভাবে? তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

কিন্তু কোম্পানিটির আইপিও শেয়ার বরাদ্দের আগে বিনিয়োগকারীরা বলেছিলেন, কারসাজি করে এই শেয়ারে আবেদন বেশি দেখানো হয়েছে। এই কারণে একজন দেশি বিনিয়োগকারী পাবেন ৪৫-৪৬টি শেয়ার, আর প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা পাবেন ১৮৮-১৮৯টি করে শেয়ার।

আজ রোববার কোম্পানিটির আইপিও শেয়ারের বরাদ্দের ফল এমনই হয়েছে বলে আবু বকর সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, ডিএসই, সিএসই ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্রোকারেজ হাউস মিলে এই কারসাজি করেছে। তিনি বলেন, এর আগে ডিএসই অনেক ব্রোকারেজ হাউস তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ৬০ রকম অনিয়ম পেয়েছিল বলে দাবি করেছিল। সুতরাং ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তারা যে কোনো অনিয়মে সিদ্ধহস্ত।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গতানুগতিক ভাষায় গণমাধ্যমকে বলেন, করসাজি হলে খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যায় ও অনিয়ম আড়াল করার প্রবণতা বাড়ছে। যা শেয়ারবাজারের জন্য কোনোভাবেই শুভ নয়। আইপিও সাকসেস গ্রুপে আইয়ুব খান নামে এক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালের বিষয়ে তদন্তের জন্য আইপিও গ্রুপের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, নাভানার আইপিও বরাদ্দে অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে। এত বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধের পরও কীভাবে এত এপ্লাই হয়েছে। এটা তদন্ত করলে অনেক কিছু বের হয়ে আসবে। সবাই মিলে কিছু একটা করা উচিত।

একই গ্রুপে মোহাম্মদ ইলিয়াছ কামাল নামে একজন কমেন্টস করেছেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। অথবা কোথাও ভুল হয়েছে। এনআরবি আবেদন ২ লাখ, বড়জোর আড়াই লাখ এর চেয়ে বেশি হতেই পারে না।’

আব্দুল্লাহ আল মামুন নামের এক আইপিও বিনিয়োগকারী বলেন, শেয়ারবাজারে বিভিন্ন হাউসে যেসব বিও বন্ধ করে দিয়েছে গ্রাহক, কিংবা বিও সাসপেন্ড হয়ে গেছে। হাউস থেকে সব বিও-তে আইপিও এপ্লাই করা হচ্ছে এবং সিরিয়াল ট্রেডিং করা হচ্ছে। এটা তদন্ত করে দেখা হোক।

দুটি স্ট্যাটাসের কমেন্টস বক্সে, আবদুল্লা আল মামুন অভিযোগ করেন, আমার মনে হচ্ছে কিছু অসাধু ব্রোকারেজ হাউস নির্ধারিত ৫০ হাজার টাকার শেয়ার বাই না করেও অ্যাপ্লিকেশন করেছে। এটা তদন্তের দাবি রাখে। কোনো কারচুপি হয়েছে কি না, শেয়ার বরাদ্দের আগে যাচাই-বাছাই করা দরকার। এমনও তো হতে পারে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা শেয়ার না কিনে শুধু ১০ হাজার টাকা আইপিওর জন্য জমা দিয়েছে!

শাহেদ মিয়া নামে আরেকজন অভিযোগ করেন, আমার হাউসের মালিকের কোডে কোটি কোটি শেয়ার আছে, বিভিন্ন কোডে জাস্ট ট্রান্সফার! তার উত্তরে মামুন বলেন, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিধি-বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত ৫০ হাজার টাকার শেয়ার বাই না করে যদি কোনো ব্রোকারেজ হাউস আইপিওর জন্য এপ্লাই করে ওই হাউসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। শেয়ার বরাদ্দের আগে প্রত্যেকটি বিও অ্যাকাউন্টের পোর্টফোলিও চেক করা দরকার।

আহসান হাবিব অভিযোগ করেন, ‘নাভানা আইপিওতে অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হোক’। অর্নব নামে একজন অভিযোগ করেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকজন যদি শেয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে তখন কারসাজির কোনো লিমিট থাকে না। আসলে আমাদের উচিত এই বাজার ছেড়ে অন্য কোনো ছোটখাটো ব্যবসায় বিনিয়োগ করা, রক্ষক যদি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তবে সেখানে আমাদের পুঁজি আজ অথবা কাল নিঃশেষ হয়ে যাবে।

জামাল হোসেন স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, নাভানা ফার্মার আইপিওতে ভ্যালিড সব অ্যাকাউন্টে কাট অফ ডেটে ৫০ হাজার টাকার শেয়ার ছিল কি না তা যাচাই করলেই থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে। এ ছাড়াও এম ইসলাম উদ্দীন নামে একজন স্ট্যাটাসে অভিযোগ করেন, ‘নাভানা ফার্মা শেয়ার বরাদ্দে কারসাজির গন্ধ পাচ্ছি’। এইভাবে একের পর এক বিনিয়োগকারী ফেসবুকে নাভানা ফার্মার শেয়ার বরাদ্দে কারসাজি হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন। আর বরাদ্দ বাতিল চাচ্ছেন।

উল্লেখ্য, নাভানা ফার্মার শেয়ারের কাট-অফ প্রাইস নির্ধারিত হওয়ার পর গত ১৩ সেপ্টেম্বর আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আবেদন গ্রহণ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯ সেপ্টেম্বর। কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করছে। সাধারণ বিনিয়োগকারী অর্থাৎ দেশি বিনিয়োগকারী ও অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে মোট ১ কোটি ৭৩ লাখ ৭ হাজার ৭০০টি শেয়ার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এই শেয়ার বরাদ্দ দেওয়ার জন্য আইপিওতে আবেদন গ্রহণ করা হয়। এতে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪৭টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারী ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪২৮টি আবেদন জমা পড়ে। যার শেয়ার সংখ্যা ১৪ কোটি ৭০ লাখ ২৬ হাজার ৪৮। তাতে টাকার অংকে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫৩ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

অপরদিকে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব থেকে আবেদন করা হয়েছে ৬ হাজার ১১৯টি। যার শেয়ার সংখ্যা ২৫ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৪। টাকার অংকে যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ১১ লাখ ৯০ হাজার। প্রাতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং যোগ্য বিনিয়োগকারীসহ মোট ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯২১টি শেয়ারে আবেদনের বিপরীতে ১৭ কোটি ৯৭ লাখ ২৩ হাজার ৬৮৯টি শেয়ার কেনার আবেদন জমা পড়েছে।

যা বরাদ্দের চেয়ে ৬ দশমিক ১৫ গুণ বেশি। বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৭১ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৪টি শেয়ার। যা টাকার অংকে ছিল ৭৫ কোটি। সেই টাকার শেয়ারের জন্য ৪৬১ কোটি ৪৫ লাখ ১ হাজার ২৫৮ টাকার জমা পড়েছে। এর আগে গত ৪ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত সময়ে আইপিওর বিডিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করে। তারা কোম্পানির শেয়ারের কাট-অফ প্রাইস ৩৩ টাকা ৯৭ পয়সা নির্ধারণ করে।

নিয়ম অনুসারে, সেই কাট-অফ প্রাইসের ওপর ৩০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির জন্য দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৪ টাকা। চলতি বছর শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসকে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়। এই টাকা কোম্পানিটি নতুন ভবন নির্মাণ, ইউটিলিটি ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণ, সেফালোস্ফোরিন ইউনিটের সংস্কার, ঋণ পরিশোধ এবং আইপিওর ব্যয় বাবদ খরচ করবে।

এক্ষেত্রে কোম্পানিকে শর্ত দেওয়া হয়েছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটি কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে না। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে আনতে ইস্যু ম্যানেজারের কাজ করছে এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার্স ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

কোম্পানির তথ্যমতে, গত ১ জুলাই ২০২১ থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ২ টাকা ৩৯ পয়সা। গত ৫ বছরে কর-পরবর্তী মুনাফার ভারিত গড় হারে ইপিএস হয়েছে ২ টাকা ৫১ পয়সা। একই সময়ে পুনর্মূল্যায়ন ছাড়া কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) ছিল ১৯ টাকা ০২ পয়সা। আর পুনর্মূল্যায়ন পরবর্তী মূল্য ছিল ৪৩ টাকা ৫৩ পয়সা।