শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টাকার মান আরও হারানোর ভয়ে পুঁজিবাজার থেকে গত দুই মাসে ৫১৩ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। গত এপ্রিল ও মে মাসে শেয়ার বিক্রি করে তারা এই টাকা তুলে নেন। একই সঙ্গে তারা বাজারও ছাড়ছেন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

পুঁজিবাজারে চার ইস্যুতে বিদেশীদের শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ছে। প্রথমত, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। তার ধাক্কা বাংলাদেশে পড়েছে। ফলে বেশকিছু দিন ধরে ডলারের বাজার অস্থির। তারা বলেন, একদিকে পুঁজিবাজার টালমাটাল, অন্যদিকে ডলারের বাজার অস্থির। এ কারণে বিদেশিরা পুঁজি হারানোর ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

দ্বিতীয়ত, বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অতি মূল্যায়িত হওয়ায় বিদেশিরা মুনাফা তুলতে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন। তৃতীয়ত, পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি’র দ্বন্দ্ব। এ কারণে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতর অবস্থান নেওয়ায়, এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান বিদেশিরা। এ কারণে তারা দেশীয় বড় বিনিয়োগকারীদের মতো শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।

চতুর্থ কারণ হলো, বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব। পাশাপাশি বিনিয়োগযোগ্য ভালো কোম্পানির অভাব রয়েছে বাজারে।
বিএসইসি’র তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে বিদেশিরা ২৪৪ কোটি ৬৫ লাখ পাঁচ হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। মে মাসে তারা বিক্রি করেছেন ২৬৯ কোটি ৩১ লাখ এক হাজার টাকার শেয়ার। যা এপ্রিলের তুলনায় ২৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বেশি। দুই মাস মিলিয়ে অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১৩ কোটি টাকার বেশি।

সিডিবিএল’র তথ্য মতে, চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের হিসাব ছিল ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪৬টি। এর মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ১৬৭৩টি। বিদেশি ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৭৮ হাজার ২৯৯টি।
১৫ জুন পর্যন্ত সময়ে সেখান থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা ৪৮৭টি কমে দাঁড়িয়েছে ৭৭ হাজার ৮১২টিতে।

অর্থাৎ দেড় মাসের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও সংখ্যা কমেছে প্রায় ৫০০টি। একটি বিওতে একজন বিনিয়োগকারী ধরা হলে গত দেড় মাসে আরও প্রায় ৫০০ বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়েছেন। গত এপ্রিলে বিদেশিরা ৩০৮ কোটি ৯৪ হাজার টাকার লেনদেন করেন। এর মধ্যে তারা শেয়ার কিনেছেন মাত্র ৬৪ কোটি ২৮ লাখ টাকার। বিপরীতে শেয়ার বিক্রি করে তুলে নিয়েছেন ২৪৪ কোটি ৬৫ হাজার টাকা।

একই অবস্থা দেখা যায় মে মাসেও। এ মাসে বিদেশিরা শেয়ার কিনেছেন মাত্র ৯৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার। বিপরীতে বিক্রি করেছেন ২৬৯ কোটি ৩১ লাখ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ তারা ১৭৩ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়েছেন। ৩১ মে পর্যন্ত ডিএসই’র ১৩০টি কোম্পানিতে বিদেশি ও প্রবাসীদের শেয়ার ছিল। এর মধ্যে টাকার অঙ্কে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটিবি) শেয়ার সবচেয়ে বেশি বিক্রি করেছেন তারা। এরপরে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা, আইডিএলসি ফাইন্যান্স ও স্কয়ার ফার্মা।

বিদেশিরা সবসময় স্থিতিশীল বাজারে শেয়ার কেনে উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে টাকার মান কমছে। ডলারের প্রাইস ওঠা-নামা করছে। প্রাইস ফিক্স হলে বিদেশিরা হিসাব করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করবেন।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহম্মেদ বলেন, ডলারের কারণ তো আছেই, পাশাপাশি পুঁজিবাজারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি’র দ্বন্দ্ব এখনও কমছে না। ফলে বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিদেশিরা স্পষ্ট ধারণা পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারা সেফ জোনে চলে যাচ্ছেন।

বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাজারে ভালোর চেয়ে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ভালো কোম্পানি খুব কম রয়েছে। নতুন কোম্পানি না পাওয়ায় বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।