শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের মৌলিক কাঁচামালের জাহাজীকরণ খরচ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশীয় কারখানাগুলোতে সিমেন্ট উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে গেছে। যে কারণে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ব্যবসা করলেও অনেক কোম্পানি মুনাফা করতে পারছে না। আবার মুনাফা করলেও আয়ের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মুনাফার সমন্বয় হচ্ছে না।

অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে পারে দেশের খুচরা বাজারেও। গ্রাহক পর্যায়ে আগের চেয়ে বাড়তি দামে সিমেন্ট কিনতে হবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে সিমেন্ট তৈরির যে কয়েকটি মূল কাঁচামাল রয়েছে, তার সবই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে ক্লিংকার অন্যতম।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক মাস আগেও প্রতি টন কাঁচামালের বিপরীতে জাহাজীকরণ খরচ ছিল ১৭ ডলার, যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। প্রতিদিনই এ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহন খরচ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি সিমেন্ট খাতে অতিমাত্রায় আয়কর ও আমদানি শুল্ক বিরাজমান থাকায় বেশির ভাগ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায় লোকসান গুনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫টির মতো দেশী-বিদেশী কোম্পানি সিমেন্ট উৎপাদন করছে। এর মধ্যে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে সাতটি কোম্পানি। এগুলো হলো কনফিডেন্স সিমেন্ট, আরামিট সিমেন্ট, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, মেঘনা সিমেন্ট, এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি মিলস ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস।

এসব কোম্পানির মধ্যে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ ও লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ এখনো তাদের ২০২১ সমাপ্ত হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। আর দেশীয় কোম্পানি আরামিট সিমেন্ট চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। বাকি কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও কোম্পানির মুনাফার ওপর এর প্রভাবের চিত্র উঠে এসেছে।

দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম কনফিডেন্স সিমেন্ট। ১৯৯৫ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রান্তিকে ভালো আয় করলেও নিট মুনাফা কমেছে। মূলত উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির নিট মুনাফা আগের হিসাব বছরের তুলনায় এ সময়ে কমেছে।

কোম্পানিটির সর্বশেষ অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০২১-২২ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) কনফিডেন্স সিমেন্টের আয় হয়েছে ১৮৪ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ১৭৮ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে উৎপাদন ব্যয় ছিল ১৬০ কোটি টাকা।

সেই এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৫ কোটি টাকা। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রথমার্ধে কোম্পানিটির নিট মুনাফা কমেছে। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ৪৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে নিট মুনাফা ছিল ৫১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

সিমেন্ট খাতের আরেক কোম্পানি এমআই সিমেন্ট চলতি ২০২১-২২ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে বিক্রি থেকে আয় করেছে ৮৭২ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৭০৮ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৭৯১ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরে ব্যয় ছিল ৬০২ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ১১ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরে নিট মুনাফা ছিল ৩০ কোটি টাকা।

প্রিমিয়ার সিমেন্ট চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে বিক্রি বাবদ আয় করেছে ৫৮৯ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির আয় ছিল ৫৯৪ কোটি টাকা। এ সময়ে উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ৫৩৩ কোটি টাকা।

আগের হিসাব বছরে এ খাতে কোম্পানিটির ব্যয় ছিল ৫০২ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরে নিট মুনাফা ছিল ২৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

মেঘনা সিমেন্ট চলতি ২০২১-২২ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আয় করেছে ৪০১ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে আয় ছিল ৪৫৭ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ৩৬১ কোটি টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরে ব্যয় ছিল ৪১৩ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরে নিট মুনাফা ছিল ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের জাহাজীকরণের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিসিএমএ।

সংস্থাটির সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির এ বিষয়ে বলেন, একদিকে জাহাজীকরণের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে দেশীয় সিমেন্ট কোম্পানিগুলো ব্যাপক লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই দীর্ঘদিন চলতে পারবে না। এ অবস্থায় সিমেন্ট কোম্পানিগুলো টিকে থাকার স্বার্থে মূল্য সমন্বয় করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এখনই যদি মূল্য সমন্বয় না করা হয় তাহলে সিমেন্ট খাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এ খাতে বিনিয়োগকৃত প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। দেশে সিমেন্টের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৪ কোটি টন। বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ৮ কোটি ৪০ লাখ টনের।

এ খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। তাছাড়া এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক লক্ষাধিক নির্মাণ শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি এ খাত থেকে সরকারি কোষাগারে শুল্ক-করের মাধ্যমে জমা করা হয়। দেশে সিমেন্টের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশেও পণ্যটির রফতানি হচ্ছে।