শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: দীর্ঘ তিন বছরের মধ্যে ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল দশা পুঁজিবাজারের। মাঝে কিছুদিন ঘুরে দাঁড়ালেও ফের অব্যাহত দরপতন চলছে পুঁজিবাজারে। এতে বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব হওয়ার পথে।

তবে আগামী বাজেটে বাজেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ সুরক্ষায় ছাড় বাড়ানোর কথা ভাবছে এনবিআর। আর নতুন প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীকে পুঁজিবাজারে আনতে কর সুবিধা বহাল থাকতে পারে। এনবিআর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১০ সালে ভয়াবহ ধসের পর থেকে বিনিয়োগকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে বাজারমুখী করা এবং নতুন প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে আনতে কর অব্যাহতি ও করছাড় সুবিধা দিয়ে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০১৪ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি ও করছাড় সুবিধা সীমিত ছিল। ২০১৫ সাল থেকে কর সুবিধা আরও বাড়ানো হয়, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

অর্থাৎ ধসের পর থেকে হিসাব করলে ২৪ বছর, আর ২০১৫ থেকে হিসাব করলে ৯ বছর এই সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। তবে কর সুবিধা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভোগ করতে পারেন না। মূলত বাজার অস্থিতিশীল বা বাজারে ধস নামার সঙ্গে জড়িত ফটকা বিনিয়োগকারীরা। সেজন্য আগামী বাজেটে করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা কোথাও কোথাও কমিয়ে আনা, আবার কোথাও কোথাও তুলে নেয়ার চিন্তা করছে এনবিআর। পুঁজিবাজার থেকে করছাড় কমিয়ে আনতে আইএমএফ ইতোমধ্যে এনবিআরকে পরামর্শ দিয়েছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ সুরক্ষায় ছাড় বাড়ানো হতে পারে। আর নতুন প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীকে পুঁজিবাজারে আনতে কর সুবিধা বহাল থাকতে পারে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধস নামার পর ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কর সুবিধা দেয়ার দাবি জানান। সে সময় সরকার পুঁজিবাজারে করছাড় সুবিধা দেয়া শুরু করে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সীমিত আকারে করছাড় সুবিধা দেয়া হয়।

পরে ২০১৫ সাল থেকে সুবিধা বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালে বাজেটে করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা বাড়ানো হয়। করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে ১৫ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। সেই সুবিধা চলতি অর্থবছর পর্যন্ত অর্থাৎ গত ৯ বছর ধরে করছাড় ও অব্যাহতি সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত সরকারি সিকিউরিটিজ ছাড়া অন্য কোনো সিকিউরিটিজের লেনদেনে করদাতাদের আয়ের ওপর এই করছাড় সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে করছাড় সুবিধা দেয়া হয়েছে তা হলো- কোম্পানি মযার্দাভুক্ত এবং এর অধীন ফার্ম মর্যাদাভুক্ত করদাতার সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে আয়ের ওপর আয়কর হার ১০ শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মার্চেন্ট ব্যাংক, বিমা, লিজিং কোম্পানি, পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি, স্টক ডিলার বা স্টক ব্রোকার কোম্পানির স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার বা শেয়ার ডিরেক্টরদের সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে আয়ের ওপর করহার ৫ শতাংশ করা হয়।

কোম্পানিসমূহের স্পন্সর শেয়ারহোল্ডার বা শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর ছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত অন্য কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, যাদের সংশ্লিষ্ট আয় বছরের যেকোনো সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের অধিক পরিমাণ শেয়ার রয়েছে, তাদের এই কোম্পানি বা কোম্পানিসমূহের সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে অর্জিত আয়ের ওপর ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ওপরে বর্ণিত করদাতা ছাড়া অন্যান্য করদাতাদের স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ লেনদেন হতে অর্জিত আয়ের ওপর প্রদেয় আয়কর হতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষায় বিশেষ করে সরকার করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে আসছে। ২০১০ সাল থেকে হিসাব করলে ২৪ বছর। আর ২০১৫ সাল থেকে হিসাব করলে ৯ বছর ধরে এই কর সুবিধা দিয়ে আসছে সরকার। তবুও পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বাজারে ধস নামায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উল্টো দিকে করছাড়ের এই সুবিধা পাচ্ছে যারা বাজার অস্থিতিশীল করা বা ধস নামার সঙ্গে জড়িত তারা বা ফটকা বিনিয়োগকারী যারা। সহজভাবে বললে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী করছাড় ও অব্যাহতির কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না।

সেজন্য আগামী বাজেটে ২০১৫ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী করছাড় ও অব্যাহতি সুবিধা সীমিত বা বাতিল করার বিষয়ে ভাবছে এনবিআর। বাতিল করা হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে করছাড় সুবিধা কীভাবে আরও বাড়ানো যেতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। তবে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, পুজিবাজারকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এনবিআর সব ধরনের সাপোর্ট দেবে। যেমন তালিকাভুক্ত কোম্পানির করছাড় সুবিধা, নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনতে আইপিও-তে কর সুবিধাসহ অন্যান্য ছাড় রাখা হতে পারে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এনবিআর পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বিনাপ্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছিল। কয়েক বছর সুয়োগ দেয়া হলেও সাড়া মেলেনি। ফলে সুবিধা তুলে নেয়া হয়। বর্তমানে আইএমএফ পুঁজিবাজারের করছাড় সুবিধা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। সেজন্য এনবিআর পুঁজিবাজারের করছাড় ও কর অব্যাহতি নিয়ে ছক কষা শুরু করেছে।

অপরদিকে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করছাড় ও কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির গেইন ট্যাক্স, বন্ড ও জিরো কুপন বন্ডসহ আরও বিভিন্ন মুনাফার ওপর সুদকে করমুক্ত রাখার বিপক্ষে মত দিয়েছে আইএমএফ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে করছাড় ও অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে আনা বা বাতিল করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এনবিআরের সঙ্গে আলোচনায় এসব সুপারিশ করা হয়েছে বলে এনবিআরের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে যত কর সুবিধা রয়েছে: পুঁজিবাজারে শেয়ার ছেড়ে মূলধন উত্তোলন করলে করপোরেট করে ছাড় পায় কোম্পানি। সাধারণ কোম্পানির ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত করের চেয়ে ১০ শতাংশ কম কর দেয় তালিকাভুক্ত কোম্পানি। অর্থাৎ করপোরেট করে ছাড় পায়। চলতি অর্থবছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে।

প্রতি বছর আর্থিক হিসাব বছর শেষে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে তালিকাভুক্ত কোম্পানি। কোনো কোম্পানি নিট মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ আবার কেউ সমপরিমাণ স্টক ডিভিডেন্ড দেয়। স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে মুনাফার অর্থের সমান শেয়ার ইস্যু করা হয় আর সেই নিট মুনাফা ব্যবসা সম্প্রসারণ বা অন্য কাজে ব্যবহার করে কোম্পানি। এই লভ্যাংশ থেকে বিনিয়োগকারী মুনাফা পায়। বছর শেষে একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে যে লভ্যাংশ পায়, সেখান থেকে বিনিয়োগকারীকে কর দিতে হয়।

তবে পুঁজিবাজারে লভ্যাংশ থেকে পাওয়া আয়ে করমুক্ত রাখা হয়েছে। বিনিয়োগকারীকে পুঁজিবাজারমুখী ও কোম্পানিকে নগদ লভ্যাংশে উদ্বুদ্ধ করতে বোনাস লভ্যাংশে কর আরোপ করা হয়েছে। আগে কোম্পানি নগদ কিংবা বোনাস লভ্যাংশ প্রদান করত। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি নিট মুনাফার ৭০ শতাংশ রিজার্ভ, রিটেইনড আর্নিংস, ফান্ড বা উদ্বৃত্ত রাখতে পারবে। আর ৩০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে শেয়ারহোল্ডারকে লভ্যাংশ (স্টক ও নগদ) হিসেবে দিতে হবে।

কোম্পানির আয়কর রিটার্ন দাখিলের আগেই এই ডিভিডেন্ড প্রদান করতে হবে। সংশ্লিষ্ট আয় বছর সমাপ্তির তারিখে কোম্পানির ব্যালান্সশিটে ৩০ শতাংশ মুনাফা প্রদর্শন করতে হবে, যা লভ্যাংশ আকারে বিতরণ করা হবে উল্লেখ করতে হবে। ৩০ শতাংশের চেয়ে কম ডিভিডেন্ড দিলে ৭০ শতাংশ রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ, ফান্ড বা উদ্বৃত্তের ওপর ১০ শতাংশ করে কর দিতে হবে।

অপরদিকে, মিউচুয়াাল ফান্ড পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ওপর আরোপ করা একই কর সুবিধা বহাল রেখেছে এনবিআর। অর্থাৎ গত এক যুগ আগে মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনা ফি বাবদ অর্জিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে নির্ধারণ করা কর ফের বহাল থাকছে। আগামী ২০২৬-২৭ করবর্ষ পর্যন্ত এই করহার বহাল থাকবে। এনবিআর সম্প্রতি এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

সম্প্রতি আগের করহার রাখতে কোম্পানিগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ অ্যান্ড মিউচুয়াল ফান্ডস আবেদন করে। সংগঠনটি পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক সংকটকালীন মুহূর্তে বাজারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির নিমিত্ত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিসমূহের আয়কর ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করতে অনুরোধ করেছে।