শেয়ারবার্তা ২৪ডটকম, ঢাকা: আজিজ মোহাম্মদ ভাই। কখনও চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়ায় প্রভাবশালী প্রযোজক। কখনও শিল্পপতি-ব্যবসায়ী। আবার কখনও মাফিয়া ডন। এমনকি জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও সোহেল চৌধুরী হত্যাকান্ডে তার জড়িত থাকারও অভিযোগ ব্যাপকভাবে গুঞ্জরিত হয়। এসব মিলিয়ে রহস্যময় এই ব্যক্তি বিগত প্রায় তিন যুগ ধরেই ব্যাপক বিতর্কিত বা আলোচিত নাম।

কিন্তু এত অভিযোগের পরও তিনি রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলায় বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে শেয়ারবাজার বিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।

কিন্তু দীর্ঘদিনেও তাকে গ্রেফতারে তেমন কোনো উদ্যোগই লক্ষ্য করা যায়নি। তিনি নিজ কোম্পানি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কেলেংকারির মামলার আসামি। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আদালতে হাজির না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. আকবর আলী শেখ গত বছর এ আদেশ দেন। একই দিন মামলাটির চার্জ গঠন করা হয়েছে। মামলার বাদী শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সম্প্রতি বিএসইসির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ রানা বলেন, আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাই দেশে নেই। অতিরিক্ত প্রিমিয়ামে শেয়ার বিক্রি করেছিল অলিম্পিক। এক্ষেত্রে বাজার থেকে টাকা নিয়ে যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল, বাস্তবে তা করা হয়নি। অন্যদিকে এই গ্রুপের সহযোগী কোম্পানি এমবি ফার্মার নামে কিছু শেয়ার ছিল। এই শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা নিয়েছে কোম্পানিটি। সিকিউরিটিজ আইনে পুরো বিষয়টি একধরনের প্রতারণা।

উল্লেখ্য, আজিজ মোহাম্মদ ভাই বাংলাদেশের বড় একজন শিল্পপতি ও চলচ্চিত্র প্রযোজক। ৫০টির বেশি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন তিনি। তিনি অলিম্পিক ব্যাটারী, অলিম্পিক এনার্জি প্লাস বিস্কুট, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্লেড, এমবি ফার্মা, টিপ বিস্কুট এবং এমপি ফ্লিমসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির মালিক। বর্তমানে সপরিবারে তিনি ব্যাংককে রয়েছেন।

১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাদের পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে বাংলাদেশে আসে। ওই পরিবার মূলত পারস্য বংশোদ্ভূত। তারা ‘বাহাইয়ান’ সম্প্রদায়ের লোক। ‘বাহাইয়ান’ কে সংক্ষেপে ‘বাহাই’ বলা হয়। উপমহাদেশের উচ্চারণে এই ‘বাহাই’ পরবর্তীতে ‘ভাই’ হয়ে যায়। ধনাঢ্য এই পরিবার পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৬২ সালে আজিজ মোহম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয় আরমানিটোলায়। মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়ে টাকা হাতিয়ে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ।

এক্ষেত্রে ১০০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে ২০০ প্রিমিয়াম নিয়ে রাইট শেয়ার ইস্যু করে অলিম্পিক। ওই প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ২০০। কিন্তু ২০০ টাকা প্রিমিয়ামে মাত্র ৩১ হাজার ৫৯০টি রাইট শেয়ারের আবেদন জমা পড়েছিল। বাকি ১ লাখ ৩ হাজার ৬১০টি শেয়ারের বিপরীতে কোনো আবেদন জমা পড়েনি। অর্থাৎ ওইভাবে রাইট শেয়ারের যে মূল্য ধরা হয়েছিল, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তা গ্রহণ করেনি। এরপরও কয়েক দফা বোনাস শেয়ার দিয়ে শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এক্ষেত্রে ১৯৯৬ সালের ৩০ জুন অলিম্পিকের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৫৪৯ টাকা। এরপর মাত্র সাড়ে ৪ মাসের ব্যবধানে একই বছরের ১৬ নভেম্বর তা ৪ হাজার ৪৭৫ টাকায় উন্নীত হয়। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে শেয়ারের দাম বেড়েছে সাড়ে ৮ গুণ। পরবর্তীতে একই মালিকের প্রতিষ্ঠান এমবি ফার্মা উচ্চ দামে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা নিয়ে যায়। এরপর আবার কমতে থাকে শেয়ারের দাম।

মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে প্রতিটি শেয়ারের দাম কমে ১ হাজার ৪০ টাকায় নেমে আসে। এই ঘটনায় কোম্পানি এবং আরও দুই ব্যক্তিকে আসামি করে ১৯৯৯ সালে মামলা দায়ের করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন কোম্পানির উদ্যোক্তা মোহাম্মদ ভাই ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এর আগে ৭ আগস্ট মামলাটির চার্জ গঠনের জন্য পূর্বনির্ধারিত থাকলেও তা পিছিয়ে ২৯ আগস্ট করা হয়েছিল। ওইদিন বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে এবং ২৯ আগস্ট দিন ধার্য করেছিল।

গত বছর মামলাটিতে চার্জ গঠন হলেও আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাই ট্রাইব্যুনালে অনুপস্থিত ছিলেন। এক্ষেত্রে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের আইনজীবী বোরহান উদ্দিন ও মোশাররফ হোসেন কাজল উপস্থিতির জন্য জন্য সময় আবেদন করেন। তবে ট্রাইব্যুনাল তা নাকচ করে দিয়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছে। যা মতিঝিল থানা বরাবর করা হয়েছে। এ মামলাটির আসামিরা হলেন অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজসহ মোহাম্মদ ভাই ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এর মধ্যে মোহাম্মদ ভাই চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি মারা গেছেন।

ওইদিন (২৪ জুলাই) আসামিদের আইনজীবী বোরহান উদ্দিন ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদ ভাইয়ের মৃত্যুর সনদ দাখিল করেন। এর আলোকে মোহাম্মদ ভাইয়ের মৃত্যুর সত্যতা যাছাইয়ে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিয়েছিল। যার মৃত্যুর সত্যতা আছে বলে ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করেছে সংশ্লিষ্ট পুলিশ। গত বছরের ৩০ নভেম্বর উচ্চ-আদালত অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলাটির স্থগিতাদেশ বাতিল করে।

বিচারক এম এনায়েতুর রহিম ও শহিদুল করিমের দ্বৈত বেঞ্চ এই বাতিলের আদেশ দেন। ২০১৩ সাল থেকে স্থগিত রয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলাটি। ১৯৯৯ সালে দায়েরকৃত মামলাটি ২০১৫ সালে শেয়ারবাজার বিষয়ক ট্রাইব্যুন্যালে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে উচ্চ-আদালতের নির্দেশে এতদিন মামলাটির বিচারকাজ বন্ধ ছিল।

সর্বশেষ গত রোববার ঢাকার গুলশানে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও ক্যাসিনোসামগ্রী উদ্ধারের ঘটনায় থানায় দুটি মামলা হলেও কোনোটিতেই আসামি করা হয়নি তাকে। তবে মামলার তদন্তে তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশন্স) ডিআইজি ড. এএফএম মাসুম রাব্বানী।
তবে গুলশানের বাসায় অভিযানের পর এবার বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পাশাপাশি আজিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিআইএফইউ) থেকে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো চিঠিতে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ৩০ দিনের জন্য ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বলা হয়েছে। এই ৩০ দিন এসব ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা তোলা কিংবা স্থানান্তর করা যাবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ওয়ান-ইলেভেনের পর বিদেশে পাড়ি জমানো আজিজ মোহাম্মদ ভাই বর্তমানে থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন। থাইল্যান্ডসহ দুবাই, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার হোটেল, বার ও রিসোর্ট ব্যবসা। বাংলাদেশেও অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস ও এমবি ফিল্মসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ও তার পরিবার। আজিজ মোহাম্মদ ভাই দীর্ঘ সময় ধরেই বিদেশে থাকলেও তার স্ত্রী নওরীন মাঝেমধ্যে দেশে আসেন।

অনেকেই বলেছেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই বিদেশে থাকলেও দেশের চলচ্চিত্র, মাদক সাম্রাজ্য ও ক্যাসিনোসহ নানা ক্ষেত্রে তার পরোক্ষ সক্রিয়তা রয়েছে। আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাফিয়া ডন ভারতীয় নাগরিক দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে রয়েছে চিত্রজগতের নানা চাঞ্চল্যকর গুঞ্জন। এর মধ্যে গুরুতর অভিযোগ হিসেবে রয়েছে চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও সোহেল চৌধুরী হত্যাকা-ের নেপথ্যে তার জড়িত থাকার অভিযোগ।

ঢাকায় একটি পার্টিতে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরার সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত নিয়ে সেই অভিযোগ আরও ঘনীভূত হয়েছিল। কথিত আছে, ওই পার্টিতে সামিরাকে চুমু দিয়েছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। ওই সময় উপস্থিত সালমান শাহ চরম ক্ষুব্ধ হয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে চড় মেরেছিলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পরই সালমান শাহর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, ওই পার্টির রেষ হিসেবেই সালমান শাহ প্রাণ হারিয়েছেন।

এছাড়া সোহেল চৌধুরীকে বনানীতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনার পরও নেপথ্যে এই আজিজের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু কোনো ঘটনারই স্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেননি রহস্যমানব আজিজ মোহাম্মদ ভাই। সর্বশেষ গত রোববার গুলশানের বাসায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে বিদেশি মদ ও ক্যাসিনোসামগ্রী জব্দ হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই।
সুত্র: দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ ও দেশ প্রতিক্ষণ ডটকম