পুঁজিবাজারে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নতুন আইপিও আসেনি

শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: সারা বিশ্বে শিল্পায়নে মূলধনের জোগান আসে পুঁজিবাজার থেকে। যদিও বাংলাদেশে শিল্পায়নের মূলধন জোগানের প্রধান উৎস ব্যাংক খাত। এক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের অবদান যৎসামান্য। তবে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে নতুন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। ফলে শিল্প খাতে দীর্ঘ সময় ধরে নতুন অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আগের আইপিও থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যবহারে ধীরগতি।
যেসব কোম্পানি আগের বছরগুলোতে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য অর্থ তুলেছিল, তাদের অনেকে এখনো সেই টাকা কাজে লাগাতে পারেনি। কেউ কেউ সামান্য ব্যবহার করেছে, আবার কেউ এক টাকাও ব্যবহার করতে পারেনি। ফলে পুঁজিবাজারে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে নতুন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। ফলে শিল্প খাতে দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজিবাজার থেকে কোনো অর্থায়ন আসছে না। ভালো কোম্পানির সংকট থাকায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভালো কোম্পানি হলো পুঁজিবাজারের প্রাণ। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে নতুন কোনো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা হতাশ। এর আগে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের পুঁজিবাজারে যে কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি ছিল দুর্বল কোম্পানি। এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরা রীতিমতো পথে বসে গেছে।
এ অবস্থায় বাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ফিরত। গত বছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হয়। কমিশন পুঁজিবাজারের কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করে। বিনিয়োগকারীরাও আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু গত এক বছরেও পুঁজিবাজার সংস্কার কার্যক্রম শেষ হয়নি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আইপিও নীতিমালা সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে না পারলেও কমিশন এ সময় দেশের সরকারি ভালো কোম্পানিগুলোকে সরাসরি তালিকাভুক্ত করতে পারত। একই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের যে শেয়ার আছে, তা বাজারে ছাড়তে জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারত। এসব কোম্পানি বাজারে এলে পুঁজিবাজারের চিত্রটাই পালটে যেত। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ব্যাংক খাতের দুরাবস্থার সময়ে দেশের শিল্পখাতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন আসত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে কোনো অর্থ সংগ্রহ না হলেও এ সময়ে ব্যাংক থেকে শিল্প খাতে ৮৩ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ শেষে শিল্প খাতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৪২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে শিল্প খাতে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৭ লাখ ২৬ হাজার ১১৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মেয়াদি ঋণ ও চলতি মূলধন বাবদ শিল্প খাতে এ ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য বলছে, আইপিওর মাধ্যমে ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৫২টি কোম্পানি ৭ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এক্ষেত্রে প্রতি বছর গড়ে আইপিওর মাধ্যমে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার অর্থায়ন হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চারটি কোম্পানি ৩২৭ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫টি কোম্পানি ১ হাজার ২৮৬ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫টি কোম্পানি ৪ হাজার ৮৪৮ কোটি,
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯টি কোম্পানি ৬৭৮ কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯টি কোম্পানি ৮৪১ কোটি টাকা আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করেছে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে কোনো অর্থায়ন হয়নি। মূলত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) থেকেই পুঁজিবাজারে নতুন কোনো আইপিও আসছে না। ফলে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে নতুন কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ব্যবস্থাপনাতে পরিবর্তন আসে। বছরে চার বার আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে যখন তালিকাভুক্ত হতে প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন কোম্পানিগুলো জানতে চায়, তালিকাভুক্ত হলে তাদের কী লাভ হবে। তারা যখন দেখে তালিকাভুক্ত হলে বিশেষ কোনো লাভ হবে না। তখন তারা আর আগ্রহ দেখায় না। এছাড়া, বর্তমানে নিম্নমুখী বাজারে শেয়ারের প্রত্যাশিত দাম পাওয়া নিয়ে উদ্যোক্তাদের সংশয় রয়েছে।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠন করা হলে সবার মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু সে প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি। গত এক বছরেও পুঁজিবাজারের কাঠামোগত সংস্কার শেষ হয়নি। আইপিও নীতিমালা সংস্কারের জন্যও উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছেন বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিএসইসি সূত্র জানিয়েছে, পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স তাদের প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, আইপিও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্টক এক্সচেঞ্জ প্রাথমিক অনুমোদন প্রদান করবে এবং স্টক এক্সচেঞ্জের সুপারিশের ভিত্তিতে বিএসইসি চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করবে। আইপিও বা পাবলিক ইস্যুর ক্ষেত্রে যারা নিরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন তাদের উপযুক্ত ও সঠিক মানদণ্ড সুপারিশমালায় দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে আইপিও অনুমোদন প্রক্রিয়ায় নিরীক্ষা কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া ভালো ও মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিসমূহ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত করতে আইপিও ভ্যালুয়েশন বা প্রাইসিংয়ের জন্য সুগঠিত মডেল তৈরি করার প্রস্তাব করা হয়। যার মাধ্যমে তালিকাভুক্তিতে আগ্রহী কোম্পানিগুলোর ন্যায্য প্রাইসিং নিশ্চিত হবে। ইস্যু ম্যানেজারদের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতে নীতিমালার কিছু অংশে পরিবর্তন আনতে বলেছে টাস্কফোর্স।
টাস্কফোর্সের সুপারিশমালার আলোকে পাবলিক ইস্যু রুলস্-এর আইনি সংস্কারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কত সময় লাগবে? এ প্রশ্নে বিএসইসির মুখপাত্র ও পরিচালক আবুল কালাম বলেন, টাস্কফোর্সের সুপারিশকৃত পাবলিক ইস্যু রুলস্ খুব শিগগিরই কমিশন অনুমোদন দেবে। পরে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইন ও বিধিতে সংশোধন আনা হবে। আশা করছি, খুব শিগগিরই এটা হবে। নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্তির বিষয়ে আমরা চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা হচ্ছে।
বিএসইসি সূত্র বলেছে, বিগত সময়ে আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানির তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। আর্থিকভাবে দুর্বল ও ভঙ্গুর কোম্পানি তালিকাভুক্ত করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ রীতিমতো লুটপাট করা হয়েছে। এমনকি আইপিওর অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যয়ের ঘটনাও ঘটেছে। আইপিওতে আসার পর কৃত্রিমভাবে কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে এর মাধ্যমেও পুঁজিবাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে একটি কারসাজি চক্র। আইপিওর আগে প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায়ও বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব কারণে বর্তমান কমিশন আইপিও ইস্যুতে এমন নীতিমালা করতে চায় যাতে ভবিষ্যতে এ বিষয়গুলো আর না ঘটে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন গনমাধ্যমকে বলেন, গত এক বছরেও বাজারে কোনো আইপিও আসেনি। এটা দুঃখজনক। এ সময় ভালো কোম্পানি আসলে বাজারে শেয়ারের যোগান বাড়ত। যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। তবে আইপিও ইস্যু নিয়ে টাস্কফোর্স সুপারিশ জমা দিয়েছে। এ সুপারিশের আলোকে যদি আমরা দেরিতে হলেও ভালো আইপিও পাই। তাহলে তা বাজারের জন্য ভালো হবে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ভালো কোম্পানিগুলোকে আনতে আইপিও প্রক্রিয়া সংস্কারের বিকল্প নেই। আমাদের বাজার যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে আইপিও শূন্য হয়ে আছে, সেহেতু আমরা মনে করি এখন সংস্কার শেষে ভালো কোম্পানিগুলোই আসবে। পুঁজিবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স এটি নিয়ে কাজ করছে।