nazime picশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বাংলাদেশের শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযমের উত্তরসূরী হিসেবে ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আসা মতিউর রহমান নিজামীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে সেই নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির।

নিজামী হলেন পঞ্চম মানবতাবিরোধী অপরাধী যার সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হলো। একই সঙ্গে তিনি প্রথম কোনো দলীয় প্রধান ও দ্বিতীয় সাবেক মন্ত্রী একাত্তরে সংঘটিত অপরাধের জন্য ফাঁসিতে ঝুলে যার দণ্ড কার্যকর হলো।  একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর (৭৩) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ১২টা ১০ মিনিটে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করেন সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা। পরে সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির কারাগার থেকে বের হয়ে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের বলেন, ‘১২টা ১০ মিনিটে নিজামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে।’

ফাঁসি কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন: ঢাকা জেলা প্রশাসক (ম্যাজিস্ট্রেট) সালাউদ্দিন আহমেদ, সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা, ডিএমপির পক্ষে ডিসি ডিবি উত্তর শেখ নাজমুল আলম, সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির, ডিসি লালবাগ মফিজ উদ্দিন।

ঘড়ির কাঁটা যখন ১২টা বেজে ০১ মিনিট তখন সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির তার হাতে ধরা রুমালটি ফেলে দেন। আর তখনই যম টুপি ও গলায় দড়ি পরিহিত নিজামীর পায়ের নিচ থেকে পাটাতন সরিয়ে ফেলেন জল্লাদ। এ অবস্থায় ১০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর তোলা হয়। সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মৃধা মৃত্যু নিশ্চিত করে ডেথ সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করেন।

এর আগে ফাঁসির বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা চলে সন্ধ্যা থেকেই। পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো নিজামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রীতি অনুযায়ী কারাগার মসজিদের ইমামকে সাথে নিয়ে জেল সুপার কনডেম সেলে যান। এরপর ইমাম আসামিকে তওবা পড়ান। ফাঁসি কার্যকরের কয়েক ঘণ্টা আগেই আসামিকে গোসল ও ইচ্ছানুযায়ী খাবার দেয়া হয়।

এদিকে সন্ধ্যা থেকে দুই অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়। এর একটিতে নিজামীর মৃতদেহ বহন করে তার গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়াতে নেয়া হবে। আলবদর নেতা থেকে পরিণত বয়সে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নেতা বনে যাওয়া নিজামী রাষ্ট্র গঠনের সরাসরি বিরোধিতা করেও গাড়িতে উড়িয়েছেন মন্ত্রীর পতাকা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী নিধন ও গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়া আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি মন্ত্রী পদে বসায়। আবার মন্ত্রী হয়েও জড়িয়েছেন নানা অপরাধের সঙ্গে। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও পেয়েছেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এরমধ্যে দিয়ে ইতিহাসের দায় ঘুচলো বাংলাদেশের, শেষ হলো নিজামীপর্বের।

বাড়তি নিরাপত্তা পাবনায়: মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরকে কেন্দ্র করে পাবনা ও সাঁথিয়াসহ জেলার সব জায়গায় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পাবনা-রাজশাহী এবং পাবনা-ঢাকাসহ সব মহ্সড়কে বিশেষ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই গুরুত্বপূর্ণ সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সব ধরনের যানবাহনে তল্লাশি চালাচ্ছে।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সিদ্দিকুর রহমান খান জানান, যদি আজ রাতেই রায় কার্যকর হয় এবং এই বিষয়টিকে কন্দ্রে করে যেকোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন করার মতো পরিবেশ নস্যাৎ করা হবে। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

তিনি আরো জানান, নিজামীর দাফন যদি তার নিজ এলাকাতে করা হয় তাহলে সেখানেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো ধরনের নাশকতা করার বা বিশৃঙ্খখলা করার চেষ্টা প্রতিরোধ করা হবে।

পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা: মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের তোড়জোড়ের মধ্যে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে নিজামীর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে তিনটি গাড়িতে নিজামীর পরিবারের সদস্যরা কারা ফটকে পৌঁছান। প্রায় দেড় ঘণ্টা কারাগারের ভেতরে অবস্থান করার পর ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বেরিয়ে চলে যান তারা।

কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজামীর ভাতিজি সাংবাদিকদের বলেন, তার চাচা বলেছেন, আমি শক্ত আছি, তোমরাও শক্ত থাকো।

প্রাণভিক্ষা চাইলেন না নিজামী: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নিজামীকে দিয়ে পঞ্চমজনের দণ্ড কার্যকর হলো। এরমধ্যে দুজন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার শেষ সুযোগটি নিয়েছিলেন। তারা হলেন- সাবেক মন্ত্রী জামায়াতের আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী। তবে তারা কেউ-ই রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা পাননি।

নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর তার সামনে খোলা ছিল কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ। তবে ওই সুযোগ নিজামী নেননি। সোমবারই নিজামীর আইনজীবী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন না নিজামী। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত প্রস্তুতির মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানান, প্রাণ ভিক্ষা চাননি নিজামী।

নিজামীর জন্ম থেকে মৃত্যু: গোলাম আযমের উত্তরসূরি হিসেবে ২০০০ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আসা মতিউর রহমান নিজামীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে। স্থানীয় বোয়ালমারি মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করা নিজামী কামিল পাস করেন ১৯৬৩ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে। মাদ্রাসার ছাত্র থাকা অবস্থায় নিজামী ১৯৬১ সালে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৬৬ থেকে তিন বছর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর একাত্তরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন নিজামী। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতার লড়াই তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে মূলত ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় আলবদর বাহিনী। ছাত্রসংঘের নেতা হিসাবে আলবদরের নেতৃত্বও নিজামীর কাঁধে বর্তায়।

আলবদর গঠিত হওয়ার পর ২৩ এপ্রিল দৈনিক পাকিস্তানে ছাত্রসংঘের সভাপতি নিজামীর একটি  বিবৃতি প্রকাশিত হয়, যাতে বলা হয়, ‘আলবদর একটি নাম, একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই আলবদর। যেখানে দুস্কৃতকারী সেখানেই আলবদর। ভারতীয় চরদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।’

স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশ সরকার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের আমলে দেশে ফেরার সুযোগ পান জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযম। স্বাধীন বাংলায় প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফেরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটি।

ওই সময় ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত জামায়াতের ঢাকা মহানগর শাখার আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। এরপর ১৯৮৩ সালে পদোন্নতি পেয়ে দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ওই পদে থেকে দলের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পান নিজামী। গোলাম আযম আমিরের পদ থেকে অবসরে গেলে ২০০০ সাল থেকে নিজামীর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় জামায়াতে ইসলামী।

পাবনা-১ আসন থেকে তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়া নিজামীকে ২০০১ সালে মন্ত্রিত্ব দেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। প্রথমে দুই বছর কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে সরকারের পরের তিন বছর ছিলেন শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বে। ওই সময়েই ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য পাচারের পথে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে, যে মামলার রায়ে গতবছর নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়। কন্টেইনার ডিপোর ইজারা নিয়ে গেটকো দুর্নীতি মামলারও আসামি সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামী।