এইচ কে জনি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: উত্থান পতনই পুঁজিবাজারের ধর্ম এটা আমরা সকলেই জানি। বাজারে সূচক ও লেনদেনের উত্থানের পর যদি পতন না হয় কিংবা পতনের পর যদি উত্থান না হয় তবে কোনভাবেই সেই বাজারকে স্বাভাবিক বলা যায় না। বরং উত্থান ও পতনের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকলেই বাজারের ভীত মজভুত হয়। সেক্ষেত্রে উত্থান-পতনের মধ্যখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে ফারাক থাকা দরকার।

কোনটাই যেন অতিরিক্ত না হয়ে যায়। আর যদি হয় তবে এটা ধরে নিতে হবে বাজার তার স্বাভাবিক গতিপথে হাটছে না। কোন একটা অদৃশ্য শক্তি বাজারের গতিপথ নিয়ন্ত্রন করছে বলেই ধরে নেয়া হয়। আমাদের দেশীয় পুঁজিবাজার এক্ষেত্রে সম্পূর্ন বিপরীতেই অবস্থান করছে। কোন কারণ ছাড়াই সূচকের অস্বাভাবিক উত্থান কিংবা পতন এ পুঁজিবাজারের ধর্ম হিসেবে রুপ লাভ করেছে। যার বড় প্রমান সাম্প্রতিক সময়ের পুঁজিবাজারের উত্থান-পতনের চিত্র।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের উত্থান হলে পতন হবে এটাই স্বাভাবিক। বিশে^র উন্নত দেশের পুঁজিবাজারগুলোর গতিবিধি পর্যালোচনা করলে সেখানেও উত্থান-পতনের চিত্র পরিলক্ষিত হবে। তবে যদি টানা উত্থানই হয় তবে সেই বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়বে।

আর টানা পতন হলে সেই বাজার কারসাজিরই ইঙ্গিত বহন করে। আর যদি স্বাভাবিক মাত্রায় উত্থানের পর পতন হলে সেটাকেও অতিমূল্যায়িত বা পতন বলা ঠিক হবে না। বরং তখন সেটাকে উত্থান বা কারেকশন বলে ধরে নিতে হবে। কিন্তু এ দেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের উত্থানকে স্বাভাবিক কিংবা পতনকে কারেকশন বলা যায় কি-না, তার কোন উত্তর কেউ দিতে পারবে না।

যদি সেটা স্বাভাবিক উত্থান অথবা কারেকশন না হয়ে থাকে তাহলে কোন কারণ ছাড়া সূচকের উলম্ফন, আবার ঠিক একইভাবে সূচকের উল্টোরথে যাত্রার কারণ কিÑ এমন প্রশ্নই বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে অতীতের সব ধকল কাটিয়ে ওঠতে শুরু করেছিল দেশের পুঁজিবাজার। ২০১০ সালের ধস পরবর্তী টানা মন্দায় বিনিয়োগকারীরা যখন বাজারের ওপর পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং বাজারের সূচক ও লেনদেন তলানীতে এসে ঠেকেছিল তখনই স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়ে ওঠেন সরকারসহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারনী মহল।

অর্থমন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্তা-ব্যক্তিদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণেই বাজার একটা ভীতের ওপর দাঁড়িয়েছিল। সেই সুবাদে প্রতিদিনই বেড়েছে সূচক ও গড় লেনদেনের পরিমাণ। এতে প্রায় সবশ্রেনীর বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বাজারে প্রবেশ করেছিলেন।

এতদসত্বেও এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেনীর বিনিয়োগকারী স্বল্পমূলধনী ও লোকসানি শেয়ার নিয়ে কারসাজি করেছে- যা কারোরই অজানা নয়। যদিও এ নিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি বিএসইসিও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং বলা হয়েছিল, বাজার কিছুটা ওভারভ্যালুয়েড হয়ে যাচ্ছে। এজন্য বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের সচেতন বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে আগামীতেও বাজার আরও এগিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিল।

কিন্তু হঠাৎ করেই মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় পুঁজিবাজার ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর হুশিয়ারি এবং উল্লেখ্যযোগ্য কারণ ছাড়া সূচকের ক্রমাবনতি বাজারকে আবারও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। নতুন করে বিনিয়োগকারীদের খাতায় যোগ হতে শুরু করেছে লোকসান! বাড়ছে আর্তনাদ! হারিয়ে যাচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ে নতুন পুরাতন সবশ্রেনীর বিনিয়োগকারীদের বুক ভরা প্রত্যাশা! ইতিমধ্যেই অনেকে নিজের শেষ সম্বলটুকুই হারিয়ে ফেলেছেন। এর কারণ কি? অথবা কি কারণে পুরো বিষয়টি উল্টো দিকে মোড় নিল এ প্রশ্নের উত্তর পেতেই যেন মরিয়া হয়ে ওঠেছেন বিনিয়োগকারীরা।

অথচ সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ মিলেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বানিজ্যমন্ত্রীও একটি স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। বিএসইসি ও ডিএসই’র নীতি-নির্ধারকরাও বিনিয়োগকারীদের আশ^স্ত করে নতুন করে বিনিয়োগে এনেছিলেন। আর সেই সুবাদেই পুঁজিবাজার বাজার মূলধন, সূচক ও লেনদেনে অতীতের সব রেকর্ডকে হার মানিয়েছিল। তাহলে কোন শক্তির ইশারায় আবারও পুঁজিবাজার পতনের গোলকধাধায় আটকে গেল?

ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষনে দেখা গেছে, গত ২৪ জানুয়ারি বাজার মূলধনে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, একই দিনে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচকও রেকর্ড গড়েছিল। এমনকি গত ২৩ জানুয়ারি লেনদেনেও সাড়ে ছয় বছরের রেকর্ডতে ছাড়িয়ে গেছে। এরপর মাত্র ৯ কার্যদিবসেই তা তলানীতে এসে ঠেকেছে।

বাজারের লেনদেন ৭০০ কোটি থেকে ২ হাজার কোটিতে আসতে ২ মাস পেরুলেও একই স্থানে ফিরে আসতে সময় লেগেছে মাত্র ৯ কার্যদিবস। অথচ এ সময়ে পুঁজিবাজারে এমন কি ঘটলো, যার জন্য বিনিয়োগকারীরা বাজার বিমুখ হয়ে পড়লেন!

বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করার জন্য সরকারসহ প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা যার যতটুকু সাধ্য তা নিয়ে চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারপরও কোথাও যেনো একটি গলদ থেকে যাচ্ছে এবং বাজার উঠতে গেলেই একটি অদৃশ্য শক্তি সূচকের পেছন থেকে নিচের দিকে টেনে ধরে। মূলত এই অদৃশ্য শক্তিটিই ১৯৯৬ সালে রাস্তার সাধারন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গেও প্রতারণা করেছে।

এই একই শক্তি ২০১০ সালেও বিনিয়োগকারীদের পথে বসিয়েছে। অনেকেরই সন্দেহ সরকারের যাবতীয় নীতি সহায়তা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সর্বোচ্চ উদারনীতি নিয়ে বাজার ওঠানোর জোর প্রচেষ্টার পরও ওই শক্তিটি আবারও বাজারকে টেনে ধরেছে, যেন বাজারটি কিছুতেই আর সামনের দিকে না এগোয়।

মূলত ২০১০ সালের ধস পরবর্তী সময়ে বিপর্যস্ত বাজারে যতবার আশার আলো দেখা গেছে এই চক্রটির কারনেই সেই আলো আর বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ধারনা করা হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাই হচ্ছে ওই গ্রুপটির বর্তমার সময়ের টার্গেট। আর কোন কিছু না বুঝেই সেই টার্গেটের শিকার হচ্ছেন সাধারন বিনিয়োগকারীরা। পরিণতিতে বাজার বারংবার উঠি উঠি করেও পতনের ধারায় ফিরে গেছে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রশীদ চৌধুরী বলেন, আমাদের ধৈর্য্যরে বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। গত ৯ কার্যদিবসে প্রান্তিক বিনিয়োগকারীদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। এতে তাদের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। দুই-একদিন সূচক মাইনাস হলেও আমরা ধরে নেই এটি কারেকশন কিংবা স্বাভাবিক পতন কিন্তু যদি টানা পতন হতে থাকে তাহলে ধরেই নিতে হবে এর সাথে বড় কোনো রাঘব-বোয়াল জড়িত আছে। ওই নেতা অবিলম্বে এ ধরনের পতনের কারন উদ্ঘাটনে বিএসইসিকে তদন্তের আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি, বাজারের ব্যাপারে জরুরী হস্তক্ষেপ করুন। নইলে যারা ম্যানুপুলেট করছে তাদেরকে নিবৃত করুন। আমাদেরকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করবেন না। সরকার তথা বিএসইসির যেহেতু সার্ভিলেন্স সফটওয়্যার আছে কাজেই তারা তো চাইলেই চিহ্নিত করতে পারেন কারা কারা এভাবে প্যানিক সেল দিয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

মিজানুর রশিদ চৌধুরী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমরা সাধারন বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসি চারটা পয়সা কামাই করার জন্য কিন্তু সেখানে যদি আমাদের পকেটের পয়সা শুধু খোয়াই যেতে থাকে তাহলে শিগগিরই এমন এক সময় আসবে যখন মার্চেন্ট ব্যাংক, হাউজগুলো আর গেমলারদের বাইরে কোনো বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

এনসিসিবিএল সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী রাশেদ আহমেদ বলেন, ২০১০ সালের ধসের রেশ এখনও কাটেনি তার। সেজন্য আগের পোর্টফোলিও সমন্বয় করতে যাননি তিনি। জমানো ৩ লাখ টাকা নিয়ে কিছুদিন আগে সাজিয়ে ছিলেন নতুন পোর্টফোলিও। ভেবেছিলেন মাঝেমধ্যে কারেকশন হলেও এবার বাজারে ধস নামবে না। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে বদলে গেছে এ বিনিয়োগকারীর ধারণা। কারণ ইতোমধ্যে লোকসানে পড়েছেন তিনি। সংশোধনের বদলে ধস তার সব ভাবনাকে এলোমেলো করে দিয়েছে।

বিডি ফাইন্যান্স সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে আবার পুঁজিবাজারে ফিরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার আমরা বাজার থেকে প্রতারিত হব না। কিন্তু এখন দেখছি ধারণা ভুল। প্রতিদিনই লোকসানের বোঝা ভারী হচ্ছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে পুঁজিবাজারে আবারও আগের মতো হয়ে যেতে পারে’ বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

ই সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী সাইদুর রহমান বলেন, ‘একটি চক্র আবারও বাজার নিয়ে কারসাজি শুরু করেছে। তারা শেয়ারের দর বাড়িয়ে বিক্রি করে দিয়ে বাজার থেকে বের হয়ে যায়। আর শেষ পর্যন্ত এর ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। পুঁজিবাজারের আগের অবস্থা আর এখনের অবস্থার মধ্যে খুব একটা ফারাক নেই বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফখর উদ্দীন আলী আহমেদ বলেন, বাজার কি কারণে আবারো পতনের ধারায় ফিরে এসেছে তা বলা মুশকিল। কারণ বাজার দরপতনের দৃশ্যমান কোন কারণ নেই।

তবে বাজারে বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা সৃষ্টিতে কোন কারসাজি চক্র কাজ করছে বলে তিনি ধারনা করছেন। তিনি বলেন, মুলত এক শ্রেনীর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর কাছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অনেকটা অসহায়।

পুঁজি আটকে থাকার কারণে অনেক বিনিয়োগকারী এখনো লেনদেনের সাহস পান না। এ সুযোগে যাদের সক্ষমতা বেশি তারা ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারী বা বাজারের ক্ষতি হলেও তারা মুনাফা করতে পারছে। তাই ক্ষতিগ্রস্তদের বিষয়ে না ভাবলেও তাদের চলবে। যে কারণে বিনিয়োগের যে বিষয়গুলোতে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন তা না করে দর ওঠানামাই যদি পর্যবেক্ষণের মূল বিষয় হয় তবে তা বাজারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কাজেই কোম্পানিগুলোর সার্বিক অবস্থান পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের পরামর্শ দেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নামধারী এক শ্রেনীর অসাধু মহল বিভিন্ন গুজবের মাধ্যমে বাজারকে প্রভাবিত করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। এ কারণে বাজারে স্থায়ী স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে না। কাজেই তিনি বিনিয়োগকারীদেরকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান।