BANK LAGOশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে স্মরনকালের ধ্বসের ৬ বছরেও ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ নেই বিনিয়োগকারীদের। এ সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী , ওষুধ, প্রযুক্তি খাতসহ বেশির ভাগ খাতের কোম্পানির চেয়ে ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা দিয়েছে। কিন্তু এসব ব্যাংকের শেয়ারের দাম বাড়েনি বরং কমেছে। এমন অবস্থাও হয়েছে যে, এখন অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে অধিকাংশ ব্যাংকই।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতের কারণে ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধস হয়েছে। এরপর হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ একের পর এক বিভিন্ন গ্রুপের অর্থ কেলেঙ্কারির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা।

এরপর নতুন করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮শ’কোটি টাকা চুরি হওয়া ব্যাংক খাতের কোম্পানির ওপর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা নেই বললেই চলে। ফলে দরপতনের পরও বেশিরভাগ কোম্পানির দাম বাড়ালে ‘পচন’ধরেছে ব্যাংক খাতের শেয়ারের।

তবে চলতি বছরের শুরুতে দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবসা তুলনামূলক ভালো হয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মুনাফা এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের শেয়ারদরে এর প্রতিফলন নেই। অভিহিত মূল্যের নিচে কেনাবেচা হচ্ছে অনেক ব্যাংকের শেয়ার। মূল্য আয় (পিই) অনুপাতও কমেছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টির মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৯টি ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ২০টি ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ৯টি ব্যাংকের মুনাফা।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সিংহভাগ ব্যাংকের মুনাফা বাড়লেও ব্যাংকিং খাতের শেয়ারদরে এর প্রতিফলন নেই। সর্বশেষ চার প্রান্তিকের গড় মুনাফার ভিত্তিতে হিসাব করলে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের গড় মূল্য আয় অনুপাত (ট্রেইলিং পিই) ৬ দশমিক ২। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুপাতটি ছিল ৬ দশমিক ৬। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকিং খাতের ট্রেইলিং পিই ছিল ৬ দশমিক ৯। এর অর্থ সময়ের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের শেয়ার আরো অবমূল্যায়িত হয়েছে।

স্টক এক্সচেঞ্জে ৮টি ব্যাংকের শেয়ারদর এখনো অভিহিত মূল্যের নিচে। এর মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ৩ টাকা ৮০ পয়সায়। প্রতিষ্ঠানটি অবশ্য প্রথম প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১১ পয়সা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবাহে যথেষ্ট গতি না থাকায় ব্যাংকগুলোয় বিপুল পরিমাণের বিনিয়োগযোগ্য তহবিল পড়ে আছে। তবে ঋণ বহুমুখীকরণ, বড় গ্রাহককে ঋণপ্রদানে অধিকতর সতর্কতা, এসএমই ও রিটেইল ব্যবসা বৃদ্ধির সুবাদে ব্যাংকিং খাতের আয় বেড়েছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি হ্রাস এবং সুদ ও কমিশন থেকে আয় বাড়ার কারণে অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে।

প্রথম প্রান্তিকে মুনাফা প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল মার্কেন্টাইল ব্যাংক। বিপরীতে মুনাফা সবচেয়ে বেশি কমেছে এক্সিম ব্যাংকের। আগের বছরের তুলনায় চলতি প্রথম প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা কমেছে ৭১ শতাংশের বেশি।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কর-পরবর্তী সমন্বিত মুনাফা ছিল ২১ কোটি ৭২ লাখ টাকা, ২০১৫ সালের একই সময়ে যা ৮৫ শতাংশ কমে যায়। তবে এক বছরের ব্যবধানে মুনাফায় আগের ধারাবাহিকতা ফিরে পায় ব্যাংকটি।

চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সমন্বিত শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৫৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪ পয়সা। এ হিসেবে চলতি প্রথম প্রান্তিকে আগের বছরের চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেড়েছে ১ হাজার ৩৭৫ শতাংশ।

মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি হ্রাস ও সুদ আয় বৃদ্ধিতে ব্যাংকটির মুনাফা বেড়েছে। ২০১৫ সালের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটিকে ২৭ কোটি টাকার সঞ্চিতি কম রাখতে হয়েছে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী মসিহুর রহমান বলেন, বাড়তি সঞ্চিতির কারণে ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে আমাদের মুনাফা কমে গিয়েছিল। তবে এ বছর আবারো ধারাবাহিকতায় ফিরে এসেছি। আমাদের লক্ষ্য টেকসই প্রবৃদ্ধি। এজন্য আমরা আয় ও মুনাফার মানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এখন আমরা খেলাপি ঋণ ও পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।

ফার্স্ব সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা এক বছরের ব্যবধানে ১১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির ইপিএস ছিল ১৯ পয়সা, যা চলতি বছরের একই সময়ে ৪০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের তুলনায় চলতি প্রথম প্রান্তিকে প্রতিষ্ঠানটির সুদ বাবদ আয় ৭৩ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য এ সময় ব্যাংকটির সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় বেড়েছে।

এক বছর আগের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সমন্বিত নিট মুনাফা বেড়েছে ৪১০ শতাংশ। ২০১৫ সালে এ ব্যাংকটির ইপিএস ছিল ২০ পয়সা, যা চলতি বছরের একই সময়ে ১ টাকা ২ পয়সায় উন্নীত হয়েছে।

২০১৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ২৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকার সঞ্চিতি রাখতে হয়, যা চলতি বছর ২০ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় নেমে আসে। সঞ্চিতির পরিমাণ কমে আসায় প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির মুনাফা অনেক বেড়েছে।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নিট মুনাফা বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।  পরিশোধিত মূলধন তুলনামূলক কম থাকায় শেয়ারপ্রতি আয়ে ব্যাংকটি ভালো অবস্থানে রয়েছে। চলতি প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৩ টাকা ২৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ১০ পয়সা।

খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতির পরিমাণ কমে আসা, বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা ও কমিশন আয় বাড়ায় মুনাফায় শতভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ইসলামী ব্যাংকের ইপিএস ছিল ২৫ পয়সা, যা চলতি প্রথম প্রান্তিকে ৫০ পয়সায় উন্নীত হয়েছে।

আগের বছরের তুলনায় চলতি প্রথম প্রান্তিকে এনসিসি ব্যাংকের সুদ বাবদ আয় বেড়েছে ৪০ শতাংশ। মূলত এ আয়ের ওপর নির্ভর করেই চলতি প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির ইপিএস আগের বছরের চেয়ে ১৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। চলতি প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৩৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৯ পয়সা।

ব্র্যাক ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে ৬৯ শতাংশ। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির ইপিএস ছিল ৫৮ পয়সা, যা চলতি বছরের একই সময়ে ৯৮ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে ইস্টার্ন ব্যাংকের ইপিএস ৩৫ শতাংশ বেড়ে  দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৪১ পয়সায়।

বিনিয়োগ ও কমিশন থেকে আয় বৃদ্ধিতে এক বছরের ব্যবধানে ওয়ান ব্যাংকের নিট মুনাফা ৯৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির ইপিএস ছিল ৩২ পয়সা, যা চলতি বছরের একই সময়ে ৬২ পয়সায় উন্নীত হয়েছে।

এ সময়ে পূবালী ব্যাংকের ইপিএস ৮৫ শতাংশ, যমুনা ব্যাংক ৬৬ শতাংশ, শাহজালাল ব্যাংক ৫২ শতাংশ, এমটিবি ৩০ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও সিটি ব্যাংকের ইপিএস ৩১ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া এবি, ঢাকা, এনবিএল, স্ট্যান্ডার্ড, ট্রাস্ট ও উত্তরা ব্যাংকের ইপিএস আগের বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।

বিপরীতে মুনাফা সবচেয়ে বেশি কমেছে এক্সিম ব্যাংকের। সুদ বাবদ আয় এবং কমিশন, এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ আয় কমে যাওয়ায় গত বছরের তুলনায় চলতি প্রথম প্রান্তিকে এক্সিম ব্যাংকের নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ৭২ শতাংশ। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকটির ইপিএস ছিল ২১ পয়সা, যা চলতি প্রথম প্রান্তিকে ৬ পয়সায় নেমে এসেছে।

এছাড়া প্রথম প্রান্তিকে প্রিমিয়ার, ব্যাংক এশিয়া, আইএফআইসি, প্রাইম, এসআইবিএল, সাউথইস্ট ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকেরও মুনাফা কমেছে।

আয় ও মুনাফা প্রসঙ্গে এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের এমডি গোলাম হাফিজ আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সব নির্দেশকেই ১৫-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে এনসিসি ব্যাংক। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে ঋণের সুদের হার যে হারে কমছে, আমানতের সুদ সে হারে কমানো যাচ্ছে না।

এদিক থেকে ব্যাংকের মুনাফার সুযোগ কমছে। তবে ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়ানোর পাশাপাশি এখন আমরা প্রতিযোগিতামূলক রেটে বড় করপোরেটদের অর্থায়ন বাড়াচ্ছি। ব্যালান্সশিট বাড়ানোর মাধ্যমেই মুনাফা প্রবৃদ্ধি ধরে রাখছি। পাশাপাশি সম্পদের মান উন্নয়নেরও চেষ্টা চলছে।