dse lago curentশেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজারে স্মরনকালের ধসের ৬ বছরেও স্থিতিশীল হয়নি দেশের পুঁজিবাজার। উল্টো এ সময়ে ফেসবুক, মোবাইলসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে বাজারে কারসাজি হয়েছে। এতে ৮ থেকে ১০ বার ছোট ছোট ধসের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে সরকার পক্ষ থেকে নেয়া হয় নানা সংস্কারমূলক কার্যক্রম ও বিশেষ প্রণোদনা। কিন্তু তাতেও বাজারে লেনদেনের উন্নতি হয়নি।

নানা সংস্কার ও প্রণোদনার পরও বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট ও লেনদেন মন্দার কারণ হিসেবে বাজার সংশ্লিষ্টরা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সক্ষমতা হ্রাস, মার্জিন ঋণে বড় অঙ্কের অর্থ আটকে থাকা এবং স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন।

তারা বলছেন, কয়েকদিন পর পর ডিএসইর সফটওয়্যার ত্রুটি বিনিয়োগকারীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী টানতে স্টক এক্সচেঞ্জ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিশ্বের সব দেশেই পুঁজিবাজারে উত্থান ও পতন নিয়মিত বিরতিতে হয়। আমাদের দেশে পতনের পর বিনিয়োগকারীরা আর এদিকে আসছেন না।

ডিএসইর তথ্যে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসেই পুঁজিবাজারে ধস শুরু হয়। একদিনেই ডিএসইর তৎকালীন সূচক (ডিজেন বা সাধারণ সূচক) পাঁচশরও বেশি পয়েন্ট পড়ে যায়। তাছাড়া ৫ ডিসেম্বরের পর থেকে বাজারে টানা দরপতন হতে থাকে। ফলে ডিজেন প্রায় ৯ হাজার পয়েন্ট থেকে নেমে শেষ পর্যন্ত সাড়ে ৩ হাজার পয়েন্টে নেমে আসে। এখনো ডিএসইর সূচকে তেমন কোনো উন্নতি নেই। বর্তমানে লেনদেন রয়েছে খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে। সাম্প্রতিক সময়ে লেনদেন কিছুটা বাড়লেও ফের তিনশ’ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে।

এদিকে বাজার ধসের পর সরকার নানা সংস্কার ও প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নেয়। এরই মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচ্যুয়ালাইজড (স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনাকে মালিকানা থেকে পৃথক) করা হয়েছে। বিএসইসির আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিএসইসিকে শক্তিশালী করা হয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আনতে আইন পাস করা হয়েছে।

বিএসইসির নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে অত্যাধুনিক সফটওয়্যার বসানো হয়েছে। শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সে ট্রাইব্যুনালে একাধিক রায়ও দেয়া হয়েছে। এছাড়া শেয়ারবাজারে প্রণোদনার অংশ হিসেবে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করেছে। ৯০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। লভ্যাংশের ওপর কর মওকুফের সীমা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউস ও স্টক এক্সচেঞ্জকে নানা সুবিধা দেয়া হয়েছে।

এতকিছুর পর ধারাবাহিক দরপতনে সপ্তাহজুড়ে অস্থির ছিল দেশের প্রধান পুঁজিবাজার। গেল সপ্তাহে প্রতিদিনই দরপতন হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে। আর অব্যাহত দরপতনে সব ধরনের মূল্য সূচকের পাশাপাশি কমেছে টাকার অংকে লেনদেনের পরিমাণ। একই সঙ্গে কমেছে লেনদেন হওয়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের দর। আর সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা। ডিএসই সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরকারের আশ্বাসের পরও বাড়াবে না পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগের সমন্বয় সময়সীমা অর্থাৎ সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট। তবে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগ শেয়ার বিক্রি না করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমন্বয় করতে নীতিগত সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তবে এখনো কোনো সার্কুলার জারি করা হয়নি। আর মূলধন সমন্বয়ের এরকম সিদ্বান্তে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে নতুন করে তৈরি হয়েছে আস্থাহীনতা। ফলে এক দিকে চলছে ধারাবাহিক দরপতন অন্যদিকে ৩শ কোটি টাকার ঘরেই ঘুরপাক খাচ্ছে শেয়ারবাজারের লেনদেন। আর এসব কারণে শেয়ারবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বলছেন, পুঁজিবাজার ধসের সময় বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হওয়ায় মার্চেন্ট ব্যাংক ও অন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখন বাজারে বেশি বিনিয়োগ করতে পারছেন না। তার ওপর বড় অঙ্কের অর্থ মার্জিন ঋণে আটকে থাকায় তাদের লেনদেনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় বাজারে নতুন তহবিল আনতে দক্ষ ও যোগ্য বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে স্টক এক্সচেঞ্জকে ভূমিকা রাখতে হবে।

এ বিষয়ে ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজারের এ দুর অবস্থা থেকে উন্নয়নে প্রথম কাজ হলো পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগের সমন্বয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুনেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সার্কুলার জারি করেনি। সার্কুলার হলে বিষয়টি জানা যাবে।

অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। বাজারের মূল্য সূচক প্রায় ৪ হাজারে চলে এসেছে। এর মূল কারণ অনিয়ম আর নানা অপকৌশলে বাজার থেকে অর্থ বেড়িয়ে যাচ্ছে। রেগুলেটরের ব্যর্থতায় বোনাস শেয়ার ও প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মধ্যমে শেয়ারবাজারের থেকে শত শত কোটি টাকা বাহিরে চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে এক্সপোজার নিয়েও প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন কেম্পানির অস্বাভাবিক দর উঠানামার কারণে বাজারে প্যানিক সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এসব বিষয়ে রেগুলেটরদের কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা দেখছি না। ফলে বাজারে ধারাবাহিক দরপতনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গেল সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রথম কার্যদিবস রোববার (২৪ এপ্রিল) লেনদেন শুরুতে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৮ হাজার ৫০৬ কোটি ৬৮ লাখ ৪৮ হাজার ৮১০ টাকায় এবং শেষ কার্যদিবসে বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) লেনদেন শেষে বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৯৮৫ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার ১৬৪ টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ৮ হাজার ৫২১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

গত সপ্তাহে টাকার অংকে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৭৫৭ কোটি ৩৪ লাখ ৮১ হাজার ৪৯৪ টাকা। যা এর আগের সপ্তাহের চেয়ে ১৭৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ কম। আগের সপ্তাহে ডিএসইতে চার দিনে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৯৩৩ কোটি ২ লাখ ৬ হাজার ৭১১ টাকা।

একই সঙ্গে গত সপ্তাহে ডিএসইতে কমেছে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ। প্রতিদিন গড়ে টার্নওভার দাঁড়িয়েছে ৩৫১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। যা তার আগের সপ্তাহে ছিল ৩৮৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে গড়ে টার্নওভার কমেছে ৩৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা বা ৯ দশমিক ০৯ শাতংশ কম।

গত সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৪৪ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ডিএস৩০ সূচক কমেছে ৫৩ দশমিক ৮১ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস কমেছে ৩২ দশমিক ৭৯ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। গেল সপ্তাহে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত মোট ৩৩০টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৫৬টির, কমেছে ২৫৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৬টির আর লেনদেন হয়নি ৫টি কোম্পানির শেয়ার।

সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারের সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমে ১৪ দশমিক ০২ পয়েন্টে অবস্থান করছে। বিগত সপ্তাহে দেশের অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সিএএসপিআই সূচক কমেছে ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সিএসই৩০ সূচক কমেছে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ, সার্বিক সূচক সিএসসিএক্স কমেছে ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ, সিএসই৫০ সূচক কমেছে ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং শরীয়াহ সিএসআই সূচক কমেছে ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ।

সপ্তাহে সিএসইতে গড়ে মোট লেনদেন হয়েছে ২৭৬টি কোম্পানির ও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার। এর মধ্যে দর বেড়েছে ৪১টির, কমেছে ২২০টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫টির। টাকার অংকে লেনদেন হয়েছে ১১০ কোটি ৫১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।