আমিনুল ইসলাম: পুঁজিবাজারের বিভিন্ন নীতি-নির্ধারক ও স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়হীনতার কারণে পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দিন দিন দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ক্রমেই কমছে মোট টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ। একই সঙ্গে কমছে উভয় বাজারের মূল্যসূচক। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে প্রাতষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীদের নিষ্কিয়তার ফলে বাজারের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। কিন্তু চলতি মাসজুড়েই সূচকের পতন ও লেনদেনে দৈন্যদশা দেখা যায়।

বিশেষ করে একই ইস্যুতে নীতি-নির্ধারকদের ভিন্নমত, আইনের সদ্ব্যবহার না হওয়াসহ নানা ইস্যুতে বাজারের স্বাভাবিক গতি ফিরে আসছে না। এছাড়া কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম্য, আইনি জটিলতা ও নীতিনির্ধারণী মহলের উদাসীনতায় দুর্বল কোম্পানিকে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন দেয়ায় বাজারের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট বাড়ছে। এতে বাজারে সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারী সমানতালে অংশগ্রহণ না করায় সাধারন বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ক্রমেই ভারী হচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারসাজি চক্র সক্রিয় থাকায় পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেন অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। ভালো শেয়ারের অভাব এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের অভাবে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না বলে মনে করছেন তারা। এদিকে বর্তমান বাজারে পতনের ধারা শুরু হবার কারণে বেশকিছু প্রাতষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর ট্রিগার-সেল এবং প্রান্তিক প্রতিবেদনে ব্যাংকসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার দৈন্যদশাও সাধারন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরী করছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

সুত্র মতে, ২০১০ সালের পর থেকে আজ অবধি বিভিন্ন সময় বাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও বারংবার তা পতনের বৃত্ত ঘূর্ণায়মান। মাঝেমধ্যে বাজারে কয়েকবার আশার আলো উঁকি মারলেও তা মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসান কমার বদলে বাড়ছে।

মূলত, রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে সরকারি  প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত না হওয়া, শাস্তি  প্রদানে ধীরগতি, জরিমানার নামে প্রহসন, কোম্পানিগুলোতে প্রফেশনাল ম্যানেজম্যান্ট ও গুড গভর্ন্যান্স না থাকা, নীতিনির্ধারণী মহলের সমন্বয়হীনতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ওটিসি মার্কেটের বেহালদশা, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অনীহা, আইপিও অনুমোদনে অস্বচ্ছতা এবং আর্থিক প্রতিবেদন তৈরিতে অনিয়মের কারণেই বিনিয়োগকারীরা বাজারে আস্থা রাখতে পারছেন না।

এতে বাজার হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক গতি। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি সর্ম্পকে নাম প্রকাশে অনিশ্চিুক এক সিকিউরিটিজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যাংকসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু হবার কারণে বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছেন। এর মধ্যে বেশকিছু কোম্পানির মুনাফা এবং আয় কমে যাওয়ায় বাজারে নিম্নমুখী প্রবনতা এসেছে। এর পাশাপাশি বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশও কিছুটা আতঙ্কগ্রস্থ করছে। স্পর্শকাতর বাজারে এমন বিষয়গুলো প্রভাব তৈরী করে থাকে।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী মাহামুদুল আলম বলেন, অব্যাহত দরপতনের কারণে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে ইচ্ছুক নন অনেক বিনিয়োগকারী। এতে বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে আসছে। তাছাড়া বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বাজারমুখী হচ্ছেন।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বলেন, ‘পেশাদার ব্যবস্থাপনা, গুড গভর্নেন্স, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত না করার কারণেই বাজারে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণেও বাজারে দরপতন হচ্ছে।’

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর হিসাবে অস্বচ্ছতা থেকে যাচ্ছে। এর ফলে শেয়ার অতিমূল্যায়িত হচ্ছে ও নানা রকম ম্যানিপুলেশন হচ্ছে বলে মনে করেন, ‘প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে কিছু উদ্যোক্তা শেয়ার বিক্রি করে বড়লোক হচ্ছে। ফলে শেয়ারবাজারে এখনো ঠকবাজি রয়েছে। এ কারণে মূল্যের বিবেচনায় বাজার ঠিক আছে কি না, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।’

তিনি আরো বলেন,‘এ ছাড়া পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বিএসইসির উচিত শুধু ইস্যু ম্যানেজারের তৈরি পেপারের ওপর নির্ভরশীল না থেকে সরেজমিন কোম্পানিগুলোকে যাচাই করা এবং কোম্পানির ট্যাক্স ফাইল দেখা।’

এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে এপেক্স ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সিইও শেরিফ মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘পুঁজিবাজারের পতন শুরু হলে সাধারনত এ পতন কিছুদিন চলতে থাকে। একদিন পতন হলে এর পরে অনেকের মধ্যে ট্রিগার-সেলের প্রবনতা থাকে। এর বাইরে আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে ঈদের পর থেকেই ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ওপর ঋণের চাপ আসা শুরু করেছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহন কম থাকায় সম্ভবত বাজার এমন নিম্নমূখী প্রবনতা দেখাচ্ছে।’