স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় পুঁজিবাজারকে। অর্থনীতির অগ্রগতির ধারাকেও তরান্বিত করে পুঁজিবাজার। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের চিত্র ভিন্ন রকম। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেলেও পুঁজিবাজার তার তুলনায় অনেক দূর্বল। মুলত পুঁজিবাজারের অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে দায়ী করা হয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও জাতীয় রাজস্ব রোর্ড (এনবিআর) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী সিদ্ধান্তকে।

প্রথমত, সম্প্রতি দেশের ইসলামি ধারার দুর্বল পাঁচ ব্যাংক একীভূত করে শরিয়াহভিত্তিক একটি ব্যাংক গঠিত হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের প্রাপ্য কোন নিয়মে পাবে তার একটি পরিকল্পনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব ব্যাংক যেহেতু দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সেহেতু এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও কম নয়।

এমতাবস্থায় বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বা টাকা পাওয়ার বিষয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। তাই শঙ্কায় এসব ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা। তবে দুর্বল এ পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নতুন ব্যাংকে কোনো অংশীদারিত্ব থাকছে না। এর ফলে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে গেছে।

দ্বিতীয়ত, চলতি বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেন বাড়তে থাকে। তলানীতে যাওয়া পুঁজিবাজারে লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। তেমনি বাজার স্থিতিশীলতার পথে হাঁটছে। এরই মধ্যে ২৮ আগস্ট নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হারানো আস্থা ফিরতে শুরু করে।

গতি ফিরে পায় দেশের পুঁজিবাজার। সেপ্টেম্বরের শুরুতেও সূচকের গতি ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে পাঠানো এক চিঠি নতুন করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। মুলত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫০ লাখ টাকা বা তার বেশি মুনাফা করেছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা চেয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে চিঠি দেয় বিএসইসি।

তৃতীয়ত, দেশের পুঁজিবাজারে মার্জিন ঋণ সংক্রান্ত গুজব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বাড়াচ্ছে উদ্বেগ। তাতে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। তবে এসব অস্থিরতা ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বিএসইসি চেয়ারম্যান ব্যস্ত একের পর এক জরিমানা ইস্যুতে। ফলে কোন ভাবে স্থিতিশীল হচ্ছে না পুঁজিবাজার।

মুলত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিএসইএক্স সূচকের অবস্থান ছিল ৫ হাজার ৪২৬ পয়েন্টে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত বছরের ১১ আগস্ট সূচকটি বেড়ে ৬ হাজার ১৬ পয়েন্টে দাঁড়ায়। তবে এর পর থেকেই আবারো ছন্দপতন ঘটে পুঁজিবাজারে। কখনো কখনো সূচক বাড়লেও সার্বিকভাবে এ সময়ে নিম্নমুখী ছিল পুঁজিবাজার। সর্বশেষ সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে সূচক দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৪ পয়েন্টে।

মুলত অন্তর্বর্তী সরকারের ১৩ মাসে সূচকটি ৯৭২ পয়েন্ট হারিয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ ১৮ আগস্ট চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচক কমেছে ৭৩৪ পয়েন্ট। মুলত রাশেদ মাকসুদ কমিশন যখন দায়িত্ব নেয় তখন ডিএসই সূচক ছিলো ৫৭৭৮.৬৩ পয়েন্ট। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইর সূচক এসে দাঁড়িয়েছে ৫০৪৪.৩৩ পয়েন্ট।

ফলে বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ আর আহাজারির মধ্যে তলানিতে পতিত পুঁজিবাজার টেনে তুলতে নীতিনির্ধারকদের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে দরপতনের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার। দিন যত গড়িয়েছে বাজার ততই তলানিতে ঠেকেছে। অব্যাহত দরপতন আর তারল্য সংকটে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও তলানিতে পৌঁছেছে। অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এমন দুর্দিনে বাজার পতিত হলেও শিগগিরই আলোর দেখা মিলবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, পুঁজিবাজার ভালো করতে সম্প্রতি বেশকিছু ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন অবমূল্যায়িত পর্যায়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসই এক পরিচালক বলেন, সরকার বদলের পর পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারী ও বাজার অংশীজনরা নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু সে আশা এখন গুড়ে বালি। দীর্ঘদিনের অংশীজন হিসেবে বাজার নিয়ে আমাদের মধ্যে এত বেশি হতাশা আগে কখনও কাজ করেনি। বাজার এখন অনেকটাই দিক নির্দেশনাহীন।

বিএসইসির সিদ্ধান্তহীনতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা বাজারকে এক অনিশ্চিত পথে ধাবিত করছে। বর্তমান বিএসইসি বাজারের মূল সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সেগুলোর সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে বাজারে আমরা আশার কোনও আলো দেখতে পারছি না।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেওয়ায় শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে গেছে। যার কারণে বাজারে পতন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ৫টি ব্যাংক একীভূতকরণ এবং ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের ঘোষণা বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছে।

অধিকাংশ তালিকাভুক্ত ব্যাংকের শেয়ার অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশাও তৈরি করেছে। একই সঙ্গে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব এবং অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে বলেও মনে করেন তারা।