শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: পুঁজিবাজার গতিশীল রাখতে সরকার গঠিত টাস্কফোর্স ও খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী বাড়াতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূলধনি মুনাফার করহার কমিয়ে আনতে হবে। তালিকাভুক্ত ও বহির্ভূত কোম্পানির মধ্যে করপোরেট করের পার্থক্য বাড়াতে হবে। মার্জিন ঋণের সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। জরিমানার টাকা বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার কাজে ব্যবহার করতে হবে। প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। পুঁজিবাজারে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় এক দিনে নামিয়ে আনতে হবে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আনতে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে করণীয় নির্ধারণে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশে এই প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। টাস্কফোর্স কমিটিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ এবং পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা আছেন।

বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ জানিয়েছেন, পুঁজিবাজার গতিশীল করতে কাজ করা হচ্ছে। সবার মতামত নিয়ে গ্রহণযোগ্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এসবের সুফল পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে টাস্কফোর্সের সদস্যদের পুঁজিবাজার গতিশীলে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতামতকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুঁজিবাজারে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত দুর্নীতির কারণ খতিয়ে দেখতেও বলা হয়েছে। টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যরা সবার মতামত এবং বিভিন্নভাবে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে এ প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গত সপ্তাহে এ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে পুঁজিবাজারের জন্য নতুন ভালো কোম্পানি আনতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সত্য তথ্য সরবরাহ জরুরি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে কোম্পানির নিরীক্ষকদের আরও বেশি তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা ফেরাতে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ যেসব ‘মোরাল হ্যাজার্ড’ আছে, সেগুলো দূর করতে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারের জন্য সবচেয়ে বড় যে বিষয় তা হচ্ছে নতুন ভালো কোম্পানি নিয়ে আসা। ভালো কোম্পানি আনতে হলে তাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা সম্ভব। এর জন্য সুশাসন সবচেয়ে জরুরি। বিগত সরকারের আমলে সুশাসনে নজর দেওয়া হয়নি। সে সময়ে বরং প্রশ্নবিদ্ধ বিভিন্ন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনা হয়েছে। সরকারের প্রভাবশালীরা অনেক ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের মতামতকেও গুরুত্ব দেয়নি।

ওই সব কোম্পানি এখন পুঁজিবাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশে রোড শো করে আর্থিক ব্যয় কতটা হয়েছে, আর তার বিনিময়ে পুঁজিবাজার কতটা লাভবান হয়েছে তার হিসাব কষে দেখা প্রয়োজন। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রোড শোতে অর্থ অপচয় হলে তা বাতিল করতে হবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হলে এ বাজার থেকে অর্থ আত্মসাৎকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, বিগত সরকারের সময়ে প্রতিবছর বাজেটের আগে কৃত্রিমভাবে পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি মন্দায় নিমজ্জিত করে রাখা হতো। এর বিনিময়ে পুঁজিবাজারের উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে বলে দাবি তোলা হতো বাজেটের আগ দিয়ে। আইসিবিকে ফান্ড দেওয়ার জন্যও সে সময়ের প্রভাবশালীরা চাপ দিতেন বলে মন্তব্য করা হয়েছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে। এভাবে বিভিন্নভাবে পাওয়া অর্থ বিগত সরকারের প্রভাবশালীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন।

অর্ন্তবর্তী সরকারের উচিত হবে পুঁজিবাজারের স্বার্থে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ রাখা। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পোষানোর জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা এবং মার্জিন ঋণের সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন বিনিয়োগকারীর সমস্যাও আলাদা। এ জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারী, উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি, সরকারি লাভজনক কোম্পানি ও বাংলাদেশে ব্যবসারত বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি- এই চার ভাগে বিনিয়োগকারীদের ভাগ করে পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ বাড়াতে খাতভিত্তিক উৎসাহমূলক পদক্ষেপ ও প্রণোদনা গ্রহণ করতে হবে।

ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, পুঁজিবাজারে গতি আনতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীসহ বড় বিনিয়োগকারীদের গেইন কর সহজ করতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগকারীদের দাবি ছিল, লভ্যাংশ প্রাপ্তির প্রথম ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত করছাড় দেওয়া। বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এটি বিবেচনা করা যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, অর্ন্তবর্তী সরকার শুরু থেকেই পুঁজিবাজারের প্রতি আন্তরিক। বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়েছে। বড় কারসাজিকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। বাকি আত্মসাৎকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে কাজ চলছে। আশা করা যায়, আগামীতে যে বাজেট আসবে, সেখানে পুঁজিবাজার নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা প্রকাশ পাবে এবং পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভালো উদ্যোগগুলো দৃশ্যমান হবে।

ডিএসই ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)-এর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, আশা করছি এবার পুঁজিবাজারের জন্য কী দরকার, সেটি খতিয়ে দেখে সরকার আসন্ন বাজেটে তা বিবেচনা করবে।