এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি কারসাজির সুস্পষ্ট প্রমাণ

শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সার্ভিল্যান্সের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক ঘটনায় এই বিভাগের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। পুঁজিবাজারে কারসাজির ঘটনা থামছে না, বরং নতুন নতুন কৌশলে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অথচ, বাজারের এসব অনিয়ম ধরার জন্য থাকা সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
করে, কিছু ক্ষেত্রে সার্ভিল্যান্স বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা পুঁজিবাজারের স্পর্শকাতর তথ্য আগে থেকেই পেয়ে গোপনে লেনদেন করছেন অথবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দিচ্ছেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হচ্ছেন, আর কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বিপুল অর্থ লাভ করছে।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএসইসির সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থা যদি কার্যকরভাবে কাজ করত তাহলে নিয়মিত এসব কারসাজি ধরা পড়ত এবং দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যেত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই কারসাজির ঘটনা নজরদারি বিভাগের ‘নাকের ডগায়’ ঘটলেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, বরং কখনও কখনও অভিযোগ উঠছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নীরব ভূমিকা পালন করছেন বা নির্দিষ্ট স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে যোগসাজশ করছেন। তেমনি একটা ঘটনা ঘটছে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের বিরুদ্ধে। কোম্পানিটি টানা ১০ কার্যদিবস বিক্রেতা শুণ্য হলেও বিএসইসি চোখে পড়ছে না। আসলে সবাই মিলে মিশে লুটপাট করছে।
ফলে বিএসইসি ও ডিএসইতে দুটি সার্ভিল্যান্স (নজরদারি) টিম রয়েছে, যারা কোম্পানিগুলোর শেয়ার লেনদেনে সার্বক্ষণিক নজরদারি করে। কোনো কোম্পানির শেয়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে অথবা কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হলে সবার আগে এই দুই সার্ভিল্যান্স টিম বুঝতে পারে। কারণ কোনো কোম্পানির শেয়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির সীমায় যখনই পৌঁছায়, তখনই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সিগন্যাল দিয়ে থাকে। সার্ভিল্যান্স টিম সেই সিগন্যালকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। তারা কারসাজিকারকদের সাথে হাত মিলিয়ে এই সিগন্যালকে দেখেও না দেখার ভান করে। কারসাজি চক্রের স্বার্থহাসিল হওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে টিম দুটি। অথচ যখনই সফটওয়্যার সিগন্যাল দেয়, তখনই যদি কোম্পানিটির ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করতো সার্ভিল্যান্স টিম, তাহলে তারা কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকে।
যার কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অত্যাধুনিক সার্ভিলেন্স সফটওয়্যারের দুর্বলতায় কারসাজি করে পার পেয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট। কারসাজিকারীরা সহজেই বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন করতে পারছে। এতে তারা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারে রূপকথার আলাদিনের চেরাগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে প্রকৌশল খাতের কোম্পানি এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল লিমিটেড। কোম্পানিটি শেয়ার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েই চলেছে। অথচ ভালো মৌল ভিত্তি শেয়ারে আস্থা সংকটে বিনিয়োগকারীরা। গত এক মাসের ব্যবধানে ৯ টাকা ৭০ পয়সার শেয়ার সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ২৩ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটির শেয়ার দর গত কিছুদিন যাবত অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় ডিএসই কোম্পানিটির কাছে কারণ জানতে চিঠি পাঠায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) জানিয়েছে, কোম্পানিটির শেয়ার এভাবে লাগামহীন হল্টেড হওয়ার পেছনে মূল্য সংবেদনশীল কোন তথ্য নেই। গত ৮ জানুয়ারি কোম্পানিটি ডিএসইর মাধ্যমে জানিয়েছে, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের ব্যাংকগুলো কোম্পানিটির এলসি খুলতে সমস্যা তৈরি করছে। ফলে কাঁচা পণ্যের অভাবে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ার দাম ছিল ৯ টাকা ৮০ পয়সা। তারপর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ার টানা হল্টেড। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনশেষে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয় ২৩ টাকা ৬০ পয়সা। মাত্র ১০ কার্যদিবসের ব্যবধানে শেয়ারটির দাম দ্বিগুনের বেশি বাড়ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এস আলমের সহযোগিরা যেমন কারসাজি করে দেশে যেমন সোয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করেছে, তেমনি পুঁজিবাজারেও তার সহযোগিরা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি শুরু করেছে। যে কারণে কোম্পানিটির শেয়ার টানা হল্টেড অবস্থায় রয়েছে।
ফলে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের সর্বশেষ এক মাসে কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় দ্বিগুনের বেশি। শেয়ার দরের এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে একটি কারসাজি চক্রের ইন্ধন রয়েছে। এছাড়া শীর্ষ একটি ব্রোকারেজ হাউজ থেকে কারসাজির অভিযোগ রয়েছে।
এসব কারসাজি চক্র থেকে দূরে থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বাজারে গুজব রয়েছে, কারসাজি চক্রের মুল হোতা একটি সিন্ডিকেট চক্র মিলে এ শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে মেতে উঠছেন। বিষয়টি তদন্ত করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। এর আগেও এ সিন্ডিকেট চক্রটি বিভিন্ন শেয়ার নিয়ে কারসাজিতে জড়িত ছিলেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিল ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে ‘বি’ ক্যাটেগরিতে লেনদেন করছে। কোম্পানিটির মোট ৯ কোটি ৮৩ লাখ ৭১ হাজার ১ শত শেয়ার রয়েছে। অনুমোদিত মূলধন ৩৫০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ৯৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার। আর প্রাতিষ্ঠানিক ৩৪ দশমিক ০৫ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে বাকি ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।