শেয়ারবার্তা ২৪ ডটকম, ঢাকা: বহুতল ভবন বীমার আওতায় আনতে তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার। কিন্তু সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। এখন নতুন করে আবার এ বিষয়টিতে জোর দিয়েছে সরকার। এরই মধ‌্যে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি ভবনগুলো বীমার আওতায় আনা গেলে পরবর্তীকালে বেসরকারি প্রতিটি ভবন বীমার আওতায় আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। হচ্ছে ভবনধস। এতে বিপুল ক্ষয়-ক্ষতির মুখে পড়ছেন ভবন মালিকরা। এছাড়া ভূমিকম্পে ভবনের তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও দেশ যে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে, তা বিশেষজ্ঞরা বেশ আগে থেকেই জানিয়ে আসছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ভবন বাধ‌্যতামূলকভাবে বিমার আওতায় আনার উদ‌্যোগ নিয়ে সরকার।

আইডিআরএ ভবন নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়গুলোকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চিঠি দেওয়ার অনুরোধ জানায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভবনের বিমা বাধ্যতামূলক করার উদ‌্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে গত ১৮ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

রাজধানীতে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), যা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন। এছাড়া খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (খউক), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়। সিটি করপোরেশন রয়েছে ১২টি এবং পৌরসভা ৩২৯টি। যেসব সিটি বা পৌরসভা এলাকায় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নেই, সেখানে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা সেই অনুমোদন দেয়, যা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘এটা (সব ভবনের বাধ‌্যতামূলক বিমা) নিয়ে এখনো কোনো অ্যানালাইসিসে (বিশ্লেষণ) আমরা যাইনি। এটা বড় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এত সংখ্যক ভবনের জন্য বাংলাদেশে পর্যাপ্ত বিমা পলিসি পাওয়া যাবে কি না। আমি যদি একটি পণ্য নিতে চাই, সেটি বাজারে সহজলভ‌্য কি না সেটা তো দেখতে হবে।’ এছাড়া সব ভবনের বিমা আমরা কীভাবে করবো, সেটার রূপরেখা থাকতে হবে। বাজেট পাস হওয়ার পর আমরা এটি নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে চিন্তা-ভাবনা করবো।

এ বিষয়ে কী করা যায় সেজন‌্য এরই মধ‌্যে পৌরসভার মেয়র ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি পাঠানো হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘দেখি তারা কী মতামত দেন। এরপর আমরা এটি কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেটা বিশ্লেষণ করবো। পরে আমাদের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে হয়তো আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসবো।’ তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ‘আমি এরকম চিঠি এখনো পাইনি। আমার কাছে এখনো এটি প্লেস হয়নি, হওয়ার পর আমি বলতে পারবো।’

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও গণপূর্ত সচিবের কাছে লেখা চিঠিতে বলা হয়, রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে ক্রমান্বয়ে বহুতল ভবনের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ভবনগুলোর ঝুঁকির আশংকাও বেড়ে যায়। বেশকিছু ভবনে শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের কারণে সম্পদ ও জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডে সম্পদ এবং প্রাণহানির আশংকা সব সময়ই থাকে। ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিশাল এলাকা ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ ধরনের বিশাল ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি মোকাবিলায় বিমা খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

এতে আরও বলা হয়, দেশে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন ঝুঁকি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন বিমার আওতায় আনার পদক্ষেপ নিতে অর্থমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। দেশের সব ভবন/বহুতল ভবনের মালিকরা অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিমার আওতায় থাকার ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এ অবস্থায় দেশের সব সরকারি-বেসরকারি ভবন বাধ্যতামূলকভাবে বিমার আওতায় আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।

এদিকে সরকারি-বেসরকরি ভবনের বিমা বাধ্যতামূলক হলে বিমা কোম্পানি, সরকার ও ভবন মালিক- সবাই লাভবান হবেন বলে মনে করছেন বিমা খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবনের বিমা বাধ্যতামূলক করা হলে সাধারণ বিমা খাতের ব্যবসা ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। এতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বিমার অবদান বাড়বে। একই সঙ্গে বড় হবে বিমার বাজার। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং ভবনের ক্ষতি হলে মালিকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন।

তারা আরও বলছেন, দেশে যে বিমা কোম্পানিগুলো রয়েছে, সেই কোম্পানিগুলো সরকারি-বেসরকারি ভবনের বিমা নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত। এক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলোর সক্ষমতার কোনো অভাব নেই। প্রয়োজন হলে দেশের বিমা কোম্পানিগুলো বিমা গ্রহণ করে সেই বিমা দেশের বাইরে পুনঃবিমা করতে পারবে।

যোগাযোগ করা হলে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্সের সিইও মো. জাহিদ আনোয়ার খান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভবন বীমার আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। একটি ভবন যখন বীমার আওতায় আসবে, তখন তার একটা নিরাপত্তা তৈরি হবে। পাশাপাশি বীমা খাত লাভবান হবে। আর বীমা খাত লাভবান হলে সরকারের রাজস্বও বাড়বে। এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। আমাদের দাবি, প্রতিটি দোকানের ট্রেড লাইসেন্স দেয়ার সময় বীমার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায় বাজারে ১০-২০টা দোকান পুড়ে যায়। এটা গ্রামে যেমন আছে, শহরেও আছে। কিন্তু এসব দোকানের বীমা না থাকায় তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পান না। এতে কেউ কেউ নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অথচ এসব দোকান বীমার আওতায় থাকলে তারা ক্ষতিপূরণ পেতেন, যা দিয়ে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারতেন। সুতরাং আমাদের দাবি, প্রতিটি ভবন বীমা আওতায় আনা উচিত। তবে প্রথমে সরকারি ভবনগুলোও যদি বীমার আওতায় আনা যায়, তা হবে খুব ভালো উদ্যোগ।

বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী বলেন, সরকার যদি সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবনের বিমা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে সেটা খুবই ভালো উদ্যোগ। এটা করলে বিমার পরিধি বাড়বে। বিমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় বাড়বে। আর প্রিমিয়াম আয় বাড়লে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। জিডিপিতে বাড়বে বিমার অবদান। অন্যদিকে যারা পলিসি নেবেন তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন, তাদের ঘরের কোনো ক্ষতি হলে বিমা দাবির মাধ্যমে রিকভারি করতে পারবে।

তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি ভবনের বিমা বাধ্যতামূলক করা হলে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বড় অংকে বেড়ে যাবে। আমার ধারণা সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ৩০-৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে। এটা করা গেলে, সেটা হবে বিরাট বড় অ্যাচিভমেন্ট।

পিপলস ইন্স্যুরেন্সের সিইও এসএম আজিজুল হোসেন বলেন, বহুতল সরকারি যেসব ভবন রয়েছে, তার বিমা বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো করতে পারবে না। তবে ব্যক্তি মালিকানার যে ভবন রয়েছে, সেই ভবনের বিমা বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো করতে পারবে। এটা (ভবনের বিমা) যদি বাধ্যতামূলক থাকে, তবেই আমরা বিমা করতে পারবো। কিন্তু এমনিতে যদি আমরা কাউকে বলি আপনার ভবন বিমা করেন, তাহলে তারা করতে চান না। আমরা এ ব্যাপারে বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ বিমা করে না। বাধ্যবাধকতা না থাকায় ভবনের বিমা পাওয়া যায় না। এখন যদি সরকার এটা বাধ্যতামূলক করে, তাহলে দেখবেন বহুতল ভবন বিমার আওতায় চলে আসবে। সেটার সুফল সব পক্ষ পাবে।

দেশে যত সংখ্যক বহুতল ভবন আছে, এর বিমা নিতে আমাদের দেশে ব্যবসা করা সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো সক্ষম কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই সেই সক্ষমতা আমাদের কোম্পানিগুলোর আছে। আমাদের ৪৩টি সাধারণ বিমা কোম্পানি আছে, প্রতিটি বিমা কোম্পানির বয়স অনেক। কোম্পানিগুলো বিমা নিয়ে রিক্স (ঝুঁকি) বাইরে শেয়ার করবে। পুনঃবিমার কাভারেজ নেবে বাইরে থেকে। সরকারি-বেসরকারি ভবনের বিমা নিতে দেশি বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সমস্যাই হবে না এবং দাবির টাকা পরিশোধেও কোনো সমস্যা হবে না।

তিনি আরও বলেন, এটা খুব ভালো উদ্যোগ। এতে সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা অনেক বেড়ে যাবে। কারণ দেশে এখন প্রচুর বহুতল ভবন রয়েছে। দেশের চিত্র পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রতিটি জেলায়ই প্রচুর বহুতল ভবন আছে। এতে বিমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বাড়ানোর যেমন একটা পথ খুলে যাবে, তেমনি ভবন মালিকরাও সুবিধা পাবেন।

এশিয়া প্যাসেফিক ইন্স্যুরেন্সের সিইও বিধু ভূষণ চক্রবর্তী বলেন, সরকারি-বেসরকারি বহুতল ভবনের বিমা বাধ্যতামূলক করা হলে সাধারণ বিমা খাতে এর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমার ধারণা সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা বেড়ে যাবে। সরকার যদি এই উদ্যোগ নেয়, সেটা হবে খুবই ভালো উদ্যোগ।

তিনি বলেন, ভবনের বিমা নিতে আমাদের বিমা কোম্পানিগুলোর কোনো সমস্যা হবে না। বিমা কোম্পানিগুলো বিমা পলিসি সম্পূর্ণ নিজের কাছে রাখে না। দুই কোটি টাকার মতো নিজের কাছে রেখে বাকিটা পুনঃবিমা করে। অর্থাৎ, ঝুঁকি অন্যের ঘাড়ে দেওয়া হয়। বিমা কোম্পানি যদি সঠিকভাবে পুনঃবিমা করে, তাহলে যত দাবিই উঠুক কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু পুনঃবিমা না করা হলে বিপদ। আর বড় ধরনের ভূমিকম্প না হলে, বিমা কোম্পানিগুলোর খুব বেশি দাবির টাকা পরিশোধ করতে হবে না।

এর আগে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ভবনের ঝুঁকি নিরসনে চলমান বিমা পরিকল্পগুলো হচ্ছে- ফায়ার ইন্স্যুরেন্স, আর্থকোয়েক ইন্স্যুরেন্স, সাইক্লোন ইন্স্যুরেন্স, ফ্লাড ইন্স্যুরেন্স, অল রিস্ক ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি। দেশের সব ভবন বা বহুতল ভবনের মালিকরা অগ্নিকাণ্ড ও ভূমিকম্পসহ বড় ধরনের দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিমার আওতায় থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।